তাওহিদের মূলনীতি – পর্ব দুই: কোথা থেকে শুরু করবো?

সালাফি দাওয়াহ বাংলা

দ্বিতীয় পাঠ: কোথা থেকে শুরু করবো?

সুতরাং, আমরা প্রথম পাঠে উল্লেখ করেছি যে, আল্লাহর নবির (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বার্তার সর্বপ্রথম ও সর্বাগ্রে ছিল তাওহিদের দিকে দাওয়াহ ― এবং মাক্কী যুগে আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসুলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাওহিদের দিকে দাওয়াহ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন, যা ১৩টি বছর স্থায়ী ছিল।

মদিনায় হিজরতের পূর্বে নবিজির (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে নাযিলকৃত কুরআনের বহু সূরা (মাক্কী সূরা) তাওহিদের প্রসঙ্গ ও বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে―অর্থাৎ, একমাত্র আল্লাহর ইবাদাতের বাধ্যবাধকতা, এভাবে করে তা এর তাৎপর্য তুলে ধরে। অন্যদিকে তাওহিদ প্রতিষ্ঠা পাওয়া, তা রুহ ও অন্তরে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হওয়া এবং সঠিক ঈমান ও সঠিক আকিদাহ সুদৃঢ় হওয়ার আগ পর্যন্ত বাহ্যিক ইবাদাতসমূহের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ওয়াজিব বিধানসমূহ নাযিল হয়নি।

তা এ কারণে যে, বাহ্যিক ইবাদাতসমূহ কেবল বিশুদ্ধ ও সঠিক তাওহিদের মাধ্যমেই শুদ্ধ ও সঠিক হতে পারে। এই বাহ্যিক আমলগুলো তাওহিদের ভিত্তির উপরই নির্মিত। আর কুরআন স্পষ্ট করে যে, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সর্বপ্রথম যে বিষয়টির দিকে মানুষকে আহ্বান করেছিলেন, অন্য যেকোনো কিছুর আগে, তা ছিল তাঁর একমাত্র আল্লাহর ইবাদাতের দিকে আহ্বান। এটাই ছিল আল্লাহর রাসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাওহিদবাদী দাওয়াহ, তাওহিদের প্রতি আহ্বান।

এই উদ্দেশ্যেই আল্লাহ (আযযা ওয়া জাল) নবি ও রাসুলদের পাঠিয়েছেন। যেভাবে আল্লাহ বলেন:

وَلَقَدۡ بَعَثۡنَا فِي كُلِّ أُمَّةٖ رَّسُولًا أَنِ ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ وَٱجۡتَنِبُواْ ٱلطَّٰغُوتَۖ
আর অবশ্যই আমরা প্রত্যেক জাতির মধ্যে রাসুল পাঠিয়েছিলাম এ নির্দেশ দিয়ে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত করো এবং তাগুতকে বর্জন করো। [আন-নাহল: ৩৬]

তিনি, আযযা ওয়া জাল, আরও বলেন:

وَمَآ أَرۡسَلۡنَا مِن قَبۡلِكَ مِن رَّسُولٍ إِلَّا نُوحِيٓ إِلَيۡهِ أَنَّهُۥ لَآ إِلَٰهَ إِلَّآ أَنَا۠ فَٱعۡبُدُونِ
আর আপনার পূর্বে আমরা যে রাসুলই প্রেরণ করেছি তার কাছে এ ওয়াহিই পাঠিয়েছি যে, আমি ব্যতীত অন্য কোনো সত্য ইলাহ নেই, সুতরাং তোমরা আমারই ইবাদাত করো। [আল-আম্বিয়া: ২৫]

এবং প্রত্যেক প্রেরিত নবি তাঁর অনুসারী ও জাতিকে বলতেন:

وَإِلَىٰ عَادٍ أَخَاهُمۡ هُودٗاۚ قَالَ يَٰقَوۡمِ ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مَا لَكُم مِّنۡ إِلَٰهٍ غَيۡرُهُۥٓۚ أَفَلَا تَتَّقُونَ
আর আদ জাতির নিকট তাদের ভাই হুদকে পাঠিয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্যকোনো সত্য ইলাহ নেই। তোমরা কি তাকওয়া অবলম্বন করবে না?’ [আল-আরাফ: ৬৫]

এটাই তাওহিদের অপরিসীম গুরুত্বের কথা প্রমাণ করে। তা তুলে ধরে, এটাই ছিল সকল রাসুল প্রেরণের (মূল) আহ্বান ও উদ্দেশ্য। তাঁদেরকে একমাত্র আল্লাহর ইবাদাতের প্রতি মানুষকে আহ্বান করার মাধ্যমেই তাঁদের দাওয়াহ শুরু করতে হয়েছিল। আর প্রত্যেক যুগ, সময় ও স্থানে রাসুলদের অনুসারীদের জন্যও একই কথা – যারা উম্মাহ ও মানবজাতির সংশোধনের প্রতি আহ্বান জানায়, তাদের প্রথম মনোনিবেশ ও মনোযোগের বিষয় হলো তাওহিদ।

এর কারণ, প্রত্যেক দাওয়াহ যা তাওহিদের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়, তা নিরর্থক ও ব্যর্থ দাওয়াহ এবং তা কোনো ফল বয়ে আনবে না। যেকোনো দাওয়াহ যা তাওহিদকে অবহেলা করে, তাওহিদকে একপাশে সরিয়ে রাখে এবং এর প্রাপ্য গুরুত্ব প্রদান করে না, তা এমন এক দাওয়াহ যা ব্যর্থ হবে এবং কোনো কল্যাণকর ফলাফল অর্জন করতে সক্ষম হবে না। এটি এমন একটি বিষয় যা সাক্ষ্যপ্রমাণ বহন করে এবং যুগ ও ইতিহাসের ইতিবৃত্তে যা সুবিদিত। প্রত্যেক দাওয়াহ যা তাওহিদের প্রতি মনোনিবেশ করে, আল্লাহর অনুমতিক্রমে তা সফল হবে, ফলপ্রসূ হবে, সমাজ ও মানবজাতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে—এবং এটা কাল ও ইতিহাসজুড়ে বেশ সুপ্রসিদ্ধ।

সুতরাং, আমরা মুসলিমদের দুর্দশাকে কোনোভাবেই উপেক্ষা করি না। প্রকৃতপক্ষে, আমরা মুসলিমদের কষ্ট-যাতনায় গভীরভাবে ব্যথিত—এবং আমরা তাদের সাহায্য করি, সমর্থন করি, তাদের ওপর যেকোনো ক্ষতি ও আঘাত প্রতিরোধে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাই—তারা আমাদের ভাই ও বোন। মুসলিমরা একটি দেহস্বরূপ—মুসলিমদের হত্যা ও তাদের নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত হতে দেখা আমাদের পক্ষে সহজ নয়। তবে, শুধু অশ্রু বিসর্জন, বা এমনকি মুসলিমদের দুর্দশায় কান্নার ভান করা, কিংবা আবেগী ভাষণ ও লেখালেখি, চিৎকার ও বিলাপে পৃথিবীকে পূর্ণ করা—এসব আমাদের জন্য যথেষ্ট নয়। এসব প্রয়োজনীয় সেই অগ্রগতিসাধন করতে পারবে না। মুসলিমদের দুর্দশার সঠিক প্রতিকার হলো, প্রথমত, সেই কারণগুলো অনুসন্ধান করা যা তাদের ওপর এ শাস্তি ও বিপর্যয় আপতিত হওয়ার পেছনে দায়ী, যা তাদের শত্রুদেরকে তাদের ওপর প্রাধান্য বিস্তার ও লাঞ্ছিত করতে সক্ষম করে তুলেছে।

এটাই হলো সূচনাবিন্দু, এবং এর মাধ্যমেই আমরা বুঝতে পারবো কেন মুসলিমরা লাঞ্ছিত হচ্ছে। কুরআন ও সুন্নাহর শিক্ষার অনুসরণ এবং সেগুলোকে যথাযথভাবে উপলব্ধির মাধ্যমেই কেবল ঐ সকল মুসলিম তাদের বর্তমান সংকট থেকে মুক্তি পেতে সক্ষম হবে। আর তার শুরু ঠিক সেখান থেকেই যেখান থেকে আল্লাহর নবিগণ যাত্রা শুরু করেছিলেন—তাওহিদ প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে।

এই সিরিজের আর্টিকেলগুলো মূলত আল-ইমাম ইবন আল-উসাইমিনের (রাহিমাহুল্লাহ) গ্রন্থাবলি এবং আল-আল্লামাহ সালিহ বিন ফাওযান বিন আব্দিল্লাহ আল-ফাওযানের (হাফিযাহুল্লাহ) ‘দুরুস মিনাল কুরআন আল-কারিম’ এর উপর ভিত্তি করে লেখা।
সোর্স: abukhadeejah.com
পরবর্তী পোস্ট পূর্ববর্তী পোস্ট
কোনো কমেন্ট নেই
কমেন্ট করুন
comment url