শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব কি উসমানীয়দের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন
ইসলামের ইতিহাসে শাইখুল ইসলাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব, জন্ম: ১১১৫ হি. (১৭০৩ খ্রি.) এবং মৃ. ১২০৬ হি. (১৭৯২ খ্রি.)-এর চেয়ে অতিমাত্রায় অপপ্রচার ও ভুল উপস্থাপনার শিকার হয়েছেন এমন আলিম খুব কমই আছেন। সুফি ও শিয়া – যারা কবরবাসীদের প্রতি ইলাহিয়াত (Divinity) ও কুসংস্কারমূলক ক্ষমতা (Superstitious power) আরোপ করে – তাঁকে তারা মনেপ্রাণে ঘৃণা করে, কারণ তিনি তাদের অনৈসলামিক ও কাউন্টার-অর্থডক্স আকিদাহ-বিশ্বাসের নিন্দা করেছিলেন, যা কুরআনের সেই আদেশের পরিপন্থি যার দাবি: ইবাদাহ একমাত্র আল্লাহর জন্যই হতে হবে এবং প্রয়োজন (Need), সাহায্য (Aid), আশ্রয় (Refuge) ও উদ্ধার (Rescue) একান্ত তাঁরই দিকে সোপর্দ করতে হবে। অপরদিকে আছে র্যাডিক্যাল খারিজি দলগুলো। তাদের কিছু অংশ তাঁকে সৌদি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম নেতা ইমাম মুহাম্মাদ বিন সাউদের ‘সিংহাসন’ পাকাপোক্তকারী হিসেবে বিবেচনা করে, ফলে তারা মনে করে তিনি স্বৈরাচারের সমর্থক। তাঁর সাথে তাদের এক স্কিতজোফ্রেনিক (Schizophrenic) সম্পর্ক দেখতে পাওয়া যায়: কেউ কেউ তাকে এমন উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করেছে যা তাদেরকে ক্ষমতাসীন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের বৈধতা দেয়, কারণ তারা বিশ্বাস করে যে তিনি ক্ষমতাসীন উসমানীয় সাম্রাজ্যের (Ottoman Empire) বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অনুমোদন দিয়েছিলেন; আবার অন্যরা তাঁকে এ ভিত্তিতে আক্রমণ করেছে যে, তাদের দাবি অনুযায়ী, তিনি উসমানীয়দের (অটোমান) বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন এবং এভাবে খিলাফাতের পতনে সাহায্য করেছিলেন।
কেউ যদি শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাবের জীবনী, তাঁর বিস্তৃত রচনাবলি এবং তাঁর সন্তান ও নাতিদের রচনাবলিও (যাদের অনেকে নিজগুণে একেকজন আলিম ছিলেন) অধ্যয়ন করে, তাহলে এটা স্পষ্ট হয়ে যাবে যে তিনি না উসমানীয়দের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন, না বিদআতে লিপ্ত ব্যক্তিদেরকে কাফির বলে আখ্যায়িত করেছেন—যেমনটা কিছু পক্ষপাতদুষ্ট দলবাজ লোকেরা দাবি করেছে। উদাহরণস্বরূপ, Quilliam Foundation-এর তালাল রজব বলেছে:এধরনের অপপ্রচারমূলক লেখা কেবল বিশিষ্ট এই আলিম এবং সালাফিদের – যারা তাঁর কিতাবসমূহ অধ্যয়ন করে – বিরুদ্ধে প্রেজুডিস বৃদ্ধিতেই সহায়তা করে। শাইখের রচনাবলির প্রাথমিক একটি অধ্যয়নই কুইলিয়াম ফাউন্ডেশন ও অন্যান্যদের অভিযোগের অসত্যতা প্রকাশ করে দেয়, যারা তাঁর শিক্ষাকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে। মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাবের বিরুদ্ধে কুইলিয়াম ফাউন্ডেশনের এই থিঙ্ক-ট্যাঙ্কের উপর্যুক্ত দাবির বিপরীতে, শাইখ নিজেই তাঁর জীবদ্দশায় উত্থাপিত অনুরূপ অভিযোগের জবাবে বলেছেন:
আমি কোনো মুসলিম ব্যক্তির ব্যাপারে (নাম ধরে) সাক্ষ্য দিই না যে সে (নিশ্চিতভাবেই) জান্নাতি বা জাহান্নামি—যদি না রাসুলুল্লাহ (ﷺ) তার ব্যাপারে সাক্ষ্য দেন। তবে আমি নেককারদের ব্যাপারে আশাবাদী এবং গুনাহগারদের ব্যাপারে শঙ্কিত।এরপর তিনি তাদের খণ্ডন করতে চলে যান যারা তাঁর বিরুদ্ধে ‘অপবাদমূলক অভিযোগ’ ও ‘বানোয়াট কথা’ উদ্ভাবন করেছে, যারা তাঁকে এ মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে যে, তিনি দ্বীনে বিদআতকারীদের কাফির বলে ঘোষণা দেন! [৩]
আর আমি মুসলিমদের মধ্যে কাউকেই কোনো গুনাহের কারণে কাফির (অমুসলিম) বলে অভিযোগ করি না, এবং তাকে ইসলামের গণ্ডি থেকেও বের করে দিই না। [২]
যারা শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাবের শিক্ষাকে অত্যাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সমর্থনে ব্যবহারের চেষ্টা করে, তাদেরও কোনো সত্যিকার ভিত্তি নেই। তারা শাইখের বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা করে, তাঁর সুস্পষ্ট বক্তব্যগুলোকে উপেক্ষা করে অস্পষ্ট বক্তব্যগুলো ব্যবহার করে। এখানে শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহহাবের অসংখ্য স্পষ্ট বক্তব্যের মাত্র একটি উপস্থাপন করা হলো – তাঁর আকিদাহ বিষয়ক রচনা ও আল-কাসিম শহরের সাধারণ মানুষ ও উলামাদের উদ্দেশ্যে তাঁর লেখা খোলা চিঠি থেকে, যেখানে তিনি কোনো অস্পষ্টতা ছাড়াই উল্লেখ করেছেন:
এবং আমি বিশ্বাস করি, মুসলিম শাসকদের কথা শোনা ও আনুগত্য করা অপরিহার্য – হোক তারা নেক বা ফাসিক – যতক্ষণ না তারা আল্লাহর অবাধ্যতার নির্দেশ দেয়। যে ব্যক্তি খিলাফাত (শাসনক্ষমতা) গ্রহণ করে এবং মানুষ তার পিছনে সমবেত হয় ও তার প্রতি সন্তুষ্ট থাকে – অথবা যদি সে তার তরবারির (জোরে) তাদের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে, যতক্ষণ না এভাবে খলিফা হয়ে যায়, [তখনও] তার প্রতি আনুগত্যশীল হওয়া ওয়াজিব এবং তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা নাজায়েয। [৪]
সুতরাং, শাসকদের আনুগত্য করা ওয়াজিব। আর যদি তারা গুনাহর নির্দেশ দেয়, তাহলে ‘স্রষ্টার অবাধ্যতায় সৃষ্টির কোনো আনুগত্য নেই’ [৫]। তবে তারা গুনাহর নির্দেশ দিলেও তাদের সাথে কৃত আনুগত্যের অঙ্গীকার (বাইআত) ত্যাগ করা যায় না। আমরা তাদের গুনাহর কাজে আনুগত্য করি না, কিন্তু কল্যাণের ওপর তাদের প্রতি আনুগত্য অব্যাহত থাকবে… [৬]
সুপ্রতিষ্ঠিত এই সালাফি অবস্থানের বিপরীতে আধুনিক চরমপন্থিদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব – যেমন সাইয়িদ কুতুব ও তাকিউদ্দিন আন-নাবাহানি (হিজবুত তাহরিরের প্রতিষ্ঠাতা) – ইসলামি আকিদাহর অন্যতম মৌলিক ভিত্তিকে প্রত্যাখ্যান করে। তা হলো: শরিয়াহর দৃষ্টিতে যা সৎকাজ, তাতে কর্তৃপক্ষের কথা শোনা ও মান্য করা; এবং অত্যাচার বা অবিচারের কারণে তাদের বিরোধিতা না করা বা তাদের আনুগত্য থেকে বেরিয়ে না আসা [৭]। কুতুব ও নাবাহানি সমগ্র মুসলিম বিশ্বকে “দারুল কুফর” (কুফরের ভূমি) ঘোষণা করে এর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক বিপ্লবের ডাক দিয়েছিল। আধুনিক ইতিহাসের কোনো সালাফি আলিমই তাদের এই মতের সাথে একমত নন; বরং তারা একে যিনদিক খারিজিদের মত বলে বিবেচনা করেন—যাদের অবশ্যই খণ্ডন করতে হবে এবং যাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। [৮]
![]() |
রেফারেন্স: The Birth of the Islamic Reform Movement in Saudi Arabia, Muhammad b. ‘Abd al-Wahhāb, Rentz, George. S. |
ফুটনোট:
[১] Talal Rajab, Re-Programming British Muslims—A Study of the Islam Channel, p. 11, Quilliam Foundation, March 2010
[২] কাসিমের (নজদ, সৌদি আরব) গ্রামবাসীদের কাছে লেখা ‘রিসালাহ ইলা আহলিল-কাসিম’ (কাসিমবাসীর প্রতি চিঠি) শীর্ষক চিঠিতে। তারা তাঁকে তাঁর ব্যাপারে ছড়ানো কিছু গুজব পরিষ্কার করতে বলে, তারপর এর জবাবে তিনি এই পুস্তিকাটি লেখেন। চিঠিটি ষোল খণ্ডে রচিত, আদ-দুরার আস-সানিয়্যাহ ফিল আজওয়িবাহ আন-নাজদিয়্যাহ গ্রন্থের ১ম খণ্ডের, ২৯-৩৫ পৃষ্ঠায় পাওয়া যায়। শাইখ আল-ফাওযানের ‘শারহ আকিদাহ আল-ইমাম আল-মুজাদ্দিদ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব’, মাকতাবাহ দার আল-মিনহাজ, রিয়াদ গ্রন্থেও এটি প্রকাশিত হয়েছে। যা এখন ইংরেজিতে সুন্নাহ পাবলিকেশন্স, মিশিগান, ইউএসেতেও পাওয়া যাচ্ছে।
[৩] শারহ আকিদাহ আল-ইমাম আল-মুজাদ্দিদ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব, পৃ. ১৪২-১৫৬
[৪] শারহ আকিদাহ আল-ইমাম আল-মুজাদ্দিদ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব, পৃ. ১২৭
[৫] আলি রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাদিস থেকে ইমাম আহমাদ কতৃক আল-মুসনাদে বর্ণিত, ১/১৩১, ১০৯৫ নং; ইবন মাসউদের হাদিস থেকে, ১/৪০৯, ৩৮৮৯ নং; ইমরান বিন হুসাইন থেকে, ৫/৬৬, ২০৬৫৩ নং; মুসলিম, ১৮৪০ নং
[৬] শারহ আকিদাহ আল-ইমাম আল-মুজাদ্দিদ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব, পৃ. ১২৮
[৭] অন্যান্য অধ্যায়ে ডকুমেন্ট করা তাদের বক্তব্যগুলো দ্রষ্টব্য