আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের (ﷺ) অবাধ্যতাই উম্মাহর বিপর্যয় ও পরাজয়ের কারণ: উহুদ যুদ্ধ থেকে শিক্ষা
মুসলিম, যারা আল্লাহর সাহায্য চায় এবং তাদের আজকের এই দুর্বলতা ও লাঞ্ছনার কারণ নিয়ে চিন্তা করে, তাদের জন্য উহুদ যুদ্ধের ঘটনায় এক গভীর শিক্ষা রয়েছে।
রাসুল (ﷺ) আসন্ন যুদ্ধের জন্য তাঁর সাহাবাদেরকে প্রস্তুত করেন এবং সাজিয়ে তোলেন। সেখানে পঞ্চাশজন অশ্বারোহী ও পঞ্চাশজন তীরন্দাজ ছিল। তিনি তীরন্দাজদের নির্দেশ দিলেন তারা যেন পাহাড়ের ছোট্ট একটি চূড়ায় তাদের অবস্থান থেকে একচুলও সরে না আসে এবং মুসলিম বাহিনীর পেছন দিক থেকে কোনো আক্রমণ হলে তা প্রতিহত করে।আল-বারা বিন আযিব (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, উহুদ যুদ্ধের দিনে আল্লাহর রাসুল (ﷺ) আবদুল্লাহ বিন জুবাইরকে (রাদিয়াল্লাহু আনহু) পঞ্চাশজন তীরন্দাজের সেনাপতি নিযুক্ত করেছিলেন। রাসুল (ﷺ) তাদের উদ্দেশ্যে বললেন,
“যদি তোমরা দেখো যে পাখিরা আমাদের টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে নিচ্ছে, তবুও আমি তোমাদের ডাক না দেওয়া পর্যন্ত এই স্থান থেকে একটুও সরবে না। আর যদি তোমরা দেখো যে আমরা শত্রুদের পরাজিত করেছি এবং তাদের পদদলিত করেছি, তবুও আমার নির্দেশ না আসা পর্যন্ত তোমরা সরবে না।”
আবদুল্লাহ বিন জুবাইরের (রাদিয়াল্লাহু আনহু) সাথে থাকা তীরন্দাজরা বললো, “যুদ্ধের গনিমত আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে, আর আপনার সঙ্গীরা (মুসলিম বাহিনী) বিজয়ী হয়েছে। তাহলে এখনও আপনি কীসের জন্য অপেক্ষা করছেন?”
আবদুল্লাহ বিন জুবাইর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, “তোমরা কি আল্লাহর রাসুলের (ﷺ) নির্দেশ ভুলে গেছো?” তারা বললো, “আল্লাহর কসম! আমরা অবশ্যই লোকেদের সাথে মিলিত হয়ে গনিমত সংগ্রহ করবো।” ফলে তারা নিজেদের অবস্থান ছেড়ে নেমে এসে অন্যদের সাথে যোগ দিলো। এতে তাদের অবস্থান থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় তারা পরাজয়ের শিকার হলো।” [১]
এখানে, আল্লাহর রাসুলের (ﷺ) কিছু সাহাবি তাদের নির্দিষ্ট অবস্থান ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, এটা ধারণা করে যে মুশরিকরা সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হয়েছে এবং আর ফিরে আসবে না। কিন্তু তাদের অবস্থান ত্যাগ করার মাধ্যমে তারা রাসুলের (ﷺ) সরাসরি আদেশ অমান্য করলেন। এরপর খালিদ বিন ওয়ালিদের নেতৃত্বে মুশরিকদের অশ্বারোহী বাহিনী পুনরায় আক্রমণ চালায় এবং সেই ফাঁকা স্থানটি শনাক্ত করে, যা তীরন্দাজদের অনুপস্থিতিতে অরক্ষিত ছিল। তারা সেই পথে প্রবেশ করে মুমিনদের আক্রমণ করতে সমর্থ হয়। ফলে আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী পরিস্থিতির পরিবর্তন হলো, এবং সত্তরজন মুমিন শহিদ হলেন।
যুদ্ধের পর মুমিনরা তাদের পরাজয়ের কারণ জানতে চাইল। বদরের যুদ্ধে তারা সংখ্যা ও অস্ত্রে কম থাকা সত্ত্বেও বিজয়ী হয়েছিল। অতঃপর আল্লাহ তাআলা তাদের উহুদের পরাজয়ের কারণ ব্যক্ত করলেন:
কী ব্যাপার! যখন তোমাদের উপর মুসিবত আসলো (উহুদের যুদ্ধে) তখন তোমরা বললে, ‘এটা কোত্থেকে আসলো?’ অথচ তোমরা তো দ্বিগুণ বিপদ ঘটিয়েছিলে (বদরের যুদ্ধে)। বলুন, ‘এটা তোমাদের নিজেদেরই কাছ থেকে’; নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছুর ওপর পূর্ণ ক্ষমতাবান। [২]
![]() |
উহুদ পাহাড়ের পাদদেশে মাসজিদ শুহাদা উহুদ, মদিনা, সৌদি আরব |
ঠিক যেভাবে আল্লাহ (আযযা ওয়া জাল) বলেছেন:
“অবশ্যই আল্লাহ তোমাদের সাথে তাঁর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেছিলেন যখন তোমরা আল্লাহ্র অনুমতিক্রমে তাদেরকে বিনাশ করছিলে, যে পর্যন্ত না তোমরা সাহস হারালে, নির্দেশ সম্বন্ধে মতভেদ সৃষ্টি করলে এবং যা তোমরা ভালবাসো তা তোমাদেরকে দেখানোর পর তোমরা অবাধ্য হলে। তোমাদের কিছু সংখ্যক দুনিয়া চাচ্ছিল এবং কিছু সংখ্যক চাচ্ছিল আখিরাত। তারপর তিনি তোমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য তাদের (তোমাদের শত্রুদের) থেকে তোমাদেরকে ফিরিয়ে দিলেন। অবশ্য তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করলেন এবং আল্লাহ মুমিনদের প্রতি অনুগ্রহশীল।” [৪]
এরপর, আল্লাহ তাদের ক্ষমা করলেন এবং তারা এক গভীর শিক্ষা লাভ করলো। এই যুদ্ধের প্রেক্ষিতে সুরা আলি ইমরানে আল্লাহ ষাটটি আয়াত নাযিল করেছেন, যা মুমিনদের জন্য শিক্ষা, সতর্কতা ও উপদেশ হিসেবে বিবেচিত।
উহুদের যুদ্ধে সাহাবাদের মধ্যে সত্তরজন শহিদ হয়েছিলেন। অন্যদিকে বদরের যুদ্ধে নবি (ﷺ) ও তাঁর সাহাবিগণ (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) মুশরিকদের ওপর দ্বিগুণ মাত্রায় আঘাত হেনেছিলেন: একশত চল্লিশজনের ক্ষয়ক্ষতি ঘটে। সত্তরজন মুশরিক বন্দি হয় এবং আরও সত্তরজন নিহত হয়।
এ কারণেই আল্লাহ উপর্যুক্ত আয়াতে বলেছেন, “...অথচ তোমরা তো (বদরের যুদ্ধে) দ্বিগুণ বিপদ ঘটিয়েছিলে।” এই প্রেক্ষিতেই আবু সুফিয়ান (তৎকালীন মুশরিক নেতা) উহুদ যুদ্ধের শেষে বলেছিলেন, “এটি বদরের দিনের পরাজয়ের প্রতিশোধের দিন—যুদ্ধের চূড়ান্ত ফলাফল এখনও অমীমাংসিত।” [৬]
সুতরাং, এটি প্রমাণ করে যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (ﷺ)-এর অবাধ্যতার কারণে মুসলিমদের থেকে বিজয় ছিনিয়ে নেওয়া হয়।
তাহলে, বর্তমান সময়ে মুসলিম উম্মাহ কী প্রত্যাশা করে? অনেক মুসলিম নির্দ্বিধায় অন্যায়-অত্যাচার করে, একে অপরের সাথে প্রতারণা করে, ব্যভিচার (Fornication), অশ্লীলতা (Lewd sexual acts), মিথ্যা বলা (Lying), চুরি (Theft), মদপান (Drinking alcohol), জুয়া (Gambling), গিবত বা পরনিন্দার (Backbiting) মতো বড়ো বড়ো গুনাহে লিপ্ত হয়। আরও আছে যারা রিবার (সুদ/Interest) লেনদেন করে, পর্নোগ্রাফি (Pornography) দেখে (দেখুন: পর্নোগ্রাফি থেকে উত্তরণ), নারীরা হিজাব ত্যাগ করে, অনেকে গান (Music) শোনে, সিনেমা-টিভি সিরিয়ালে (TV soaps) আসক্ত, আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করে, স্বামী-স্ত্রীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে—এবং এই তালিকা আরও দীর্ঘ!
এই উম্মাহর মধ্যে লাখ লাখ মানুষ রয়েছে যারা কবরের মৃতদের ডাকে এবং নানা ধরনের বিদআতি কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়—মিলাদুন্নবি (ﷺ) উদযাপন থেকে শুরু করে কবরের ওপর মাজার নির্মাণ, মৃতদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা, জ্যোতিষী ও গণকদের শরণাপন্ন হয়! এই অবস্থায় তারা আসলেই কি আল্লাহর সাহায্য আশা করে?!
আবু হুরাইরাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর সাহাবিদের জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা কি জানো প্রকৃত দেউলিয়া কে?” সাহাবিরা উত্তরে বললেন, “হে আল্লাহর রাসুল! আমাদের মধ্যে দেউলিয়া হলো সেই ব্যক্তি যার কাছে কোনো দিরহাম (টাকা-পয়সা) বা সম্পদ নেই।”
রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বললেন: “আমার উম্মাহর মধ্যে প্রকৃত দেউলিয়া ঐ ব্যক্তি যে কিয়ামাতের দিন সালাত (নামাজ), সাওম (রোজা) ও যাকাত আদায় করে উপস্থিত হবে। কিন্তু এরই সাথে—অমুককে গালি দেওয়া, তমুকের ওপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ, কারো সম্পদ গ্রাস, কারো রক্ত ঝরানো এবং অন্যজনকে প্রহার করার পাপ নিয়ে আসবে।
তাহলে, যারা সালাত আদায় করে না, যাকাত প্রদান করে না, রামাদানের সিয়াম পালন করে না—এবং যারা শিরক, কুসংস্কার বা বিদআতি কর্মকাণ্ডে জড়িত, তাদের অবস্থা কতটা ভয়াবহ?
মুসলিম উম্মাহর বর্তমান অবস্থা এটাই। তাহলে তারা কীভাবে আল্লাহর সাহায্য প্রত্যাশা করে?
রাস্তায় আরও বিক্ষোভ, মিছিল, আত্মঘাতী বোমা হামলা (Suicide bombings), সন্ত্রাসী কার্যকলাপ (Terrorist attacks), সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র, চরমপন্থী দল গঠন ইত্যাদির মাধ্যমে উম্মাহর সংশোধন সম্ভব নয়—এসব কোনোভাবেই (শরিয়াহসম্মত) পদ্ধতি নয়।
নবি নুহ (আলাইহিস সালাম) তাঁর সম্প্রদায়ের কাছে এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছিলেন:
“আর বলেছি, ‘তোমাদের রবের নিকট ক্ষমা চাও, নিশ্চয়ই তিনি মহাক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের ওপর মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষণ করবেন। এবং তিনি তোমাদেরকে সমৃদ্ধ করবেন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে এবং তোমাদের জন্য স্থাপন করবেন উদ্যান ও প্রবাহিত করবেন নদী-নালা।” [৮]
[২] সুরা আলি ইমরান: ১৬৫
[৩] আত-তাবাকাত (৩/৪৭৬)
[৪] আলি ইমরান: ১৫২
[৫] যাদুল মাআদ (পৃ. ৪০১), মুআসসাসাহ আর-রিসালাহ সংস্করণ, বৈরুত, ২০০৯ খ্রি./১৪৩০ হি.
[৬] দেখুন: সহিহ আল-বুখারি (৩৯৮৬ নং.)
[৭] মুসলিম (২৫৮১ নং), তিরমিজি (২৪১৮ নং]
[৮] সুরা নুহ: ১০-১২
جزاك الله خيراً
آمین واياك