যারা আহলুল বিদআতের প্রতি নরম এবং আহলুস সুন্নাহর প্রতি কঠোর তাদের ব্যাপারে একজন সুন্নির অবস্থান

সালাফি দাওয়াহ বাংলা
সালাফদের দৃঢ় বক্তব্য: যারা আহলুল বিদআতের প্রতি শিথিল এবং আহলুস সুন্নাহর প্রতি কঠোর তাদের ব্যাপারে একজন সুন্নির অবস্থান | আলি বিন আল-মাদিনির সাথে আহমাদ বিন হাম্বলের আচরণ




জকাল আমরা দেখি অনেকেই সালাফিয়্যাহ ও সুন্নাহর দাবিদার, অথচ তারা সালাফিয়্যাহর মূলনীতির বিরুদ্ধাচরণ করে। তারা সালাফিদের সারিতে ঢুকে পড়ে এবং ধীরে ধীরে তাদের বিরুদ্ধে অপতৎপরতা চালাতে শুরু করে, এমনকি শেষপর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। অথচ আহলুল বিদআত ও আহলুল আহওয়া (বিদআত ও খেয়ালখুশির অনুসারী) তাদের জিহ্বা থেকে নিরাপদ থাকে। তারা সালাফিয়্যাহর পোশাক পরিহিত অবস্থায় আবির্ভূত হয় এবং আহলুস সুন্নাহর বিরুদ্ধে তাদের বক্তব্য নিবদ্ধ করে। বিপদ হচ্ছে, আহলুল বিদআত যখন আহলুস সুন্নাহকে আক্রমণ ও মানহানি করে, সালাফি ও আহলুল ইলমগণ তাদের অপপ্রচার ও আহলুস সুন্নাহর বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগগুলো কখনোই মেনে নেন না; কিন্তু যখন তা আহলুস সুন্নাহ দাবিদার কেউ বা পূর্বে আহলুস সুন্নাহর সাথে সংশ্লিষ্ট থাকা কোনো ব্যক্তির (যারা পরে বিচ্ছিন্ন হয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে চলে গেছে) পক্ষ থেকে আসে, তখন তাঁরা তা শনাক্ত করতে পারেন না। ফলে আহলুল বিদআত এসব মুখায্‌যিলাহ (সত্যের অনুসারীদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতাকারী) থেকে নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত থাকে। নিশ্চয়ই, আহলুল বিদআত বলে বেড়ায়: “তোমাদের বিরুদ্ধে কথা আমরা বলছি না, তোমাদেরই কেউ বলছে!”

তাহলে এটা কি আরও ক্ষতিকর নয়? এই বিশ্বাসঘাতকরাই আহলুস সুন্নাহর সারিকে বিভক্ত করে, কারণ তাদের মধ্যে কিছু লোক (বিশেষত যুবসমাজ) তাদের সম্মান করে, তাদের সালাফি মনে করে, তাদেরকে হুমকি হিসেবে দেখে না। ফলে সালাফিদের সারি এমন ব্যক্তির কারণে বিভক্ত হয়ে যায়, যতক্ষণ না কেউ তাদের খণ্ডনে এগিয়ে আসে। ইমাম আহমাদের উদাহরণ দেখুন: যখন আলি ইবনুল মাদিনি আহলুল বিদআতের হাতিয়ারে পরিণত হয়ে আহলুস সুন্নাহর বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেন, তখন ইমাম আহমাদ তাকে বর্জন ও সতর্ক করলেন। আলি ইবনুল মাদিনি ছিলেন সুন্নাহ ও হাদিসের একজন ইমাম। আবু হাতিম আর-রাযি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: “আলি ইবনুল মাদিনি হাদিস  ও ইলালের (কোনো বর্ণনার সনদের দুর্বলতা চিহ্নিতকরণ) ইলমে মানুষের জন্য এক নিদর্শন ছিলেন। আহমাদ বিন হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহ) তাকে নাম ধরে ডাকতেন না; বরং তার প্রতি সম্মানের কারণে ‘আবুল হাসান’ বলে সম্বোধন করতেন।” [১] কিন্তু কুরআন সংক্রান্ত বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের সময় আলি ইবনুল মাদিনি জাহমিয়্যাহদের বক্তব্যে এসে গিয়েছিলেন, আত্মসমর্পণ করেছিলেন এবং (মৌখিকভাবে) মেনে নিয়েছিলেন, যদিও অন্তরে তিনি তা ঘৃণ্য মনে করতেন এবং নিজের মধ্যে আহলুস সুন্নাহর মতবাদই ধারণ করতেন। বস্তুত, ইবনুল মাদিনি ইমাম আহমাদের দৃঢ় অবস্থানের জন্য তাঁর প্রশংসা করতেন। আবু ইয়ালা আল-মাওসিলি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: “আমি আলি ইবনুল মাদিনিকে বলতে শুনেছি, “আল্লাহ এই দ্বীনকে দুজন ব্যক্তির মাধ্যমে সুদৃঢ় করেছেন, তাদের সাথে তৃতীয় কেউ নেই: মুরতাদদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের দিন আবু বকর আস-সিদ্দিক, আর মিহনার দিন আহমাদ ইবনু হাম্বল।” [২] আল-মাইমুনি বলেন: “আমি আলি ইবনুল মাদিনিকে বলতে শুনেছি, “আল্লাহর রাসুল ()-এর পর ইসলাম রক্ষায় আহমাদ ইবনু হাম্বলের মতো কেউ দাঁড়ায়নি।” আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, “হে আবুল হাসান, আবু বকর আস-সিদ্দিকও নন?” তিনি উত্তর দিলেন, “আবু বকরও নন, কারণ আবু বকরের সাহায্যকারী ও সঙ্গী ছিল; কিন্তু আহমাদ বিন হাম্বলের কোনো সাহায্যকারী বা সঙ্গী ছিল না (যারা তাঁর পক্ষে দাঁড়িয়েছিল)।” [৩]

যাইহোক, যখন আলি আল-মাদিনি (আল্লাহ তার ওপর রহম করুন) বিদআতিদের তৈরি খালকে কুরআন (কুরআন সৃষ্ট) সংক্রান্ত পরীক্ষার (মিহনাহ) সময় নতি স্বীকার করেন এবং আত্মসমর্পণ করেন, তখন তিনি নিজেকে তাদের দাবির কাছে সমর্পণ করতে বাধ্য বোধ করেন। তিনি এই ভুলের পথে পা বাড়ালেন এবং বিদআতিদের কাছে নতি স্বীকার করলেন। আলি আল-মাদিনি ছিলেন হাদিসের একজন ইমাম ও আলিম, এবং তিনি ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলের (রাহিমাহুল্লাহ) প্রশংসা করার ব্যাপারে সুপরিচিত ছিলেন, এমনকি মিহনার সময় ইমাম আহমাদের অনড় অবস্থান দেখে বিস্মিতও হয়েছিলেন। তবুও ইমাম আহমাদ তাকে বর্জন করেছিলেন এবং তার বর্ণনাগুলো গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকেন। আলি আল-মাদিনির এই আত্মসমর্পণে আহলুস সুন্নাহ ও আহলুল হাদিসের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে, যা তাঁদের মাঝে তার মর্যাদাকে গুরুতরভাবে ক্ষুণ্ন করেছিল। ইবনু রজব (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: “ইবনুল মাদিনিকে কুরআনের সৃষ্টি সংক্রান্ত পরীক্ষায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল, এবং তিনি চাপের মুখে নতি স্বীকার করেন। এরপর তিনি (জাহমি বিদআতি) ইবনু আবি দুআদের নিকটবর্তী হন যাতে তার মাধ্যমে দুনিয়াবি কিছু লাভ করতে পারেন। ফলে তিনি তার সাহচার্যে লিপ্ত হন এবং তাকে সম্মান দেখাতে থাকেন। এ কারণে তিনি কিছু জটিল ও গুরুতর সমস্যায় জড়িয়ে পড়েন। অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকে যে, তিনি ইবনু আবি দুআদকে খুশি করতে গিয়ে সুবিদিত হাদিস বিদ্বানদের বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করেন। এজন্য ইমাম আহমাদ তাকে বর্জন করেন—এবং তার প্রতি অসন্তোষ বাড়তে থাকলে মানুষের চোখে তিনি যেন একজন কাফির জিন্দিকে পরিণত হন। ইমাম আহমাদ তার বর্ণনাগুলো বর্জন করেছিলেন, একইভাবে ইবরাহিম আল-হারবি ও অন্যান্য উলামারাও। ইয়াহিয়া বিন মাঈন বলতেন, ‘তিনি ভীত অবস্থায় ছিলেন, তাই তার বিরুদ্ধে কিছু বলা যায় না।’ তাকে নির্দোষ প্রমাণে ইবনু মাঈনের এই কথাই যদি সীমাবদ্ধ থাকত! কিন্তু তার প্রকৃত অবস্থা তা-ই যা আমরা বর্ণনা করেছি।” [৪]

এমনটা যদি আমাদের সময়ে এমন কারো হাতে ঘটতো—যে নিজেকে সালাফি বলে দাবি করা সত্ত্বেও বিদআতের ক্ষেত্রে আত্মসমর্পণ করে এবং নমনীয়তা দেখায়, পথভ্রষ্টতার দিকে আহ্বানকারীদের প্রতি ঝুঁকে পড়ে এবং তাদের জন্য অজুহাত পেশ করে—ফলে কেউ যদি তার বিরুদ্ধে দাঁড়ায় ও দৃঢ় অবস্থান নেয়, তখন মুমাইয়িরা, যারা বিদআতিদের সাথে মিশে, কী বলতো? তারা তো এখনই বলে: সালাফিয়্যাহর এই ছাত্রের কঠোরতা দেখো! অথবা দেখো সালাফি আলিমদের কঠোরতা! কিন্তু বাস্তবে, এই বিরোধীরাই আহলুস সুন্নাহর প্রতি কঠোর হয় যখন তারা সালাফিদের বিরুদ্ধে কথা বলে ও তাঁদের খণ্ডন করে, অথচ বিদআতিদের ব্যাপারে নিশ্চুপ থাকে, তাদের সাথে মিশে যায়, তাদের প্রশংসা করে, তাদের সাথে এক মঞ্চে অংশগ্রহণ করে এবং প্রকাশ্যে তাদের সাহায্য করে। তারা সুন্নাহর রক্ষায় সালাফদের মানহাজ ও আকিদায় অটল ব্যক্তিদের আক্রমণ ও গালিগালাজ করে। তাই এমন ব্যক্তিকে খণ্ডন ও তার থেকে সতর্ক করা হয়। ইমাম আবু মুহাম্মাদ ইবনু তামিম আল-হাম্বলি (রাহিমাহুল্লাহ) ইমাম আহমাদকে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন: “তিনি বিদআতিদের ও তাদের নিকটবর্তী ব্যক্তিদের প্রতি কঠোর ছিলেন, যারা তাদের পরিত্যাগ করতো না—এমনকি তাদের আকিদাহ যদি সঠিকও হতো। ইমাম আহমাদ আলি আল-মাদিনি, ইয়াহিয়া বিন মাঈন ও আল-হুসাইন আল-কারাবিসিকে বর্জন করেছিলেন। ইয়াহিয়া বিন মাঈন তাঁর সামনে তাওবাহ করার পরই কেবল এই বর্জন প্রত্যাহৃত হয়।” [৫]

হাজ্জাজ আস-সাকাফি বলেন: আমি আহমাদকে (রাহিমাহুল্লাহ) জিজ্ঞাসা করলাম, “যে ব্যক্তি মিহনার সময় আত্মসমর্পণ করেছিল, তার কাছ থেকে কি আমি হাদিস লিখবো?” তিনি উত্তর দিলেন, “তাদের কাছ থেকে আমি কিছু লিখি না।” [৬] হুবাইশ বিন সিনদি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: “আবু আবদুল্লাহকে (আহমাদ ইবনু হাম্বল) জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, “যারা পরীক্ষার সময় নতি স্বীকার করেছিল, তাদের থেকে কি আমরা হাদিস লিখবো? আপনার কাছ থেকে বর্ণিত আছে যে আপনি আল-কাওয়ারিরি থেকে হাদিস লিখতে অনুমতি দিয়েছেন?” তিনি এই দাবি খণ্ডন করে বললেন, “আমি তাদের কারো কাছ থেকেই হাদিস বর্ণনা করি না, তাহলে আমি কীভাবে কাউকে তাদের কাছ থেকে হাদিস লেখার আদেশ দিতে পারি?” [৭]

আজ আমরা এমন বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য দেখতে পাই, যেখানে কিছু লোক সালাফি দাওয়াহর আলিমদেরকে কঠোর ও সীমালঙ্ঘনকারী বলে বর্ণনা করে। এই অভিযোগগুলো তাদের কাছ থেকে আসে যারা বিদআত ও বিদআতিদের মুখের ওপর কথা বলা থেকে নীরব থাকে, যারা বিদআতের বিষয়গুলোতে কোমল আচরণ করে, বিদআতের দিকে আহ্বানকারীদের প্রতি উদার বা নিদেনপক্ষে নিশ্চুপ থাকে। তারা সালাফিয়্যাহর শাইখদেরকে কঠোর বলে আখ্যায়িত করে! কী তাঁদের কঠোরতা? কোন বিষয়ে তাঁরা কঠোর? বাস্তবতা হলো: তারাই প্রকৃতপক্ষে কঠোর! তারা ইখওয়ানি, তাবলিগি, আশআরি, সুফি, আকলানি আধুনিকতাবাদী (ʿAqlānī Modernists)—সবার ব্যাপারে নিশ্চুপ থাকে, তাদের সাথে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করে, কারণ তাদের মতে “এটাই হিকমাহ (প্রজ্ঞা)।” তারা এই অকাজকে হিকমাহর পর্দায় আড়াল করে রাখে, যাতে মুসলিম সন্তানেরা ক্ষতি ও পথভ্রষ্টতার মধ্যে পড়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে, হিকমাহ হলো প্রত্যেক বিষয়কে তার যথাযোগ্য স্থানে স্থাপন করা। সুতরাং, দ্বীন যখন কঠোরতা দাবি করে তখন তা সঠিক, আর যখন নম্রতা দাবি করে তখন তা-ই সঠিক।

নবি () বলেছেন, “আল্লাহ দয়ালু ও কোমল এবং তিনি প্রতিটি কাজে কোমলতাকে ভালোবাসেন।” এটি আমাদের কাছে অজানা নয়—কারণ দাওয়াহর মূলনীতি এটাই। আল্লাহ বলেন, “আল্লাহর দয়ায় আপনি তাদের প্রতি কোমল-হৃদয় হয়েছিলেন; যদি আপনি রুক্ষ ও কঠোরচিত্ত হতেন তবে তারা আপনার আশপাশ থেকে সরে পড়তো। কাজেই আপনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিন এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন এবং কাজেকর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করুন, তারপর আপনি কোনো সংকল্প করলে আল্লাহর ওপর নির্ভর করবেন; নিশ্চয়ই আল্লাহ (তার ওপর) নির্ভরকারীদের ভালোবাসেন।” আল্লাহ তাআলা রাসুলকে এভাবেই নির্দেশ দিয়েছেন। এটাই মূলনীতি।

তবে বহু আয়াত ও হাদিস রয়েছে যা নির্দেশ করে যে, বিশেষ সময় ও স্থানে কঠোরতা সঠিক। যদি কেউ বাতিলের সমর্থন করতে আসে, বাতিলের সহায়তায় জেদ ধরে বা বাতিল ও এর অনুসারীদের সাহায্য করে, তবে সেই পরিস্থিতিতে কঠোরতা অবলম্বন করাই যথার্থ। নবি () কাদারিয়্যাহদের (তাকদির অস্বীকারকারী) সম্পর্কে বলেছেন, “তারা অসুস্থ হলে তাদের দেখতে যেও না, আর তারা মারা গেলে তাদের জানাযায় অংশগ্রহণ করো না।” তিনি দ্বীনে নতুন বিদআত সৃষ্টিকারী বা বিদআতিদের সহায়তাকারীদের সম্পর্কে বলেছেন, “বিদআতি ও তার আশ্রয়দাতার ওপর আল্লাহ, ফেরেশতাগণ ও সমগ্র মানবজাতির লানত।” খাওয়ারিজদের ব্যাপারে আল্লাহর রাসুল () বলেছেন, “তারা কুরআন তিলাওয়াত করবে, কিন্তু তা তাদের গলার নিচে নামবে না; তারা দ্বীন থেকে এমনভাবে বের হবে যেমন তির তার লক্ষ্যভেদ করে বের হয়।” তিনি বলেন, “তারা যদি আমি তোমাদের মাঝে থাকা অবস্থায় আবির্ভূত হয়, তখন তাদেরকে আমি আদ জাতির মতো জবাই করবো।” ইবনু উমার কাদারিয়্যাহদের সম্পর্কে বলেছেন, “তাদের জানিয়ে দাও, আমি তাদের থেকে মুক্ত এবং তারাও আমার থেকে মুক্ত।” আবু হুরাইরাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘আল্লাহর রাসুল () বলেছেন: “আমার উম্মাহর শেষ যুগে এমন কিছু লোক আবির্ভূত হবে যারা এমন বিষয় বর্ণনা করবে যা তোমরা ও তোমাদের পূর্বপুরুষেরা কখনো শোননি। সুতরাং, তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকবে এবং দূরে থাকবে। আল্লাহ তাআলা বলেন:

وَإِذَا رَأَيْتَ الَّذِينَ يَخُوضُونَ فِي آيَاتِنَا فَأَعْرِضْ عَنْهُمْ
“আর আপনি যখন তাদেরকে দেখেন, যারা আমাদের আয়াতসমূহ সম্বন্ধে উপহাসমূলক আলোচনায় মগ্ন হয়, তখন আপনি তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবেন।” [সুরা আল-আনআম: ৬৮]
ইমাম আত-তাবারি (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর তাফসিরে (৫/৩৩০) বলেন: “এই আয়াতটি একটি সুস্পষ্ট প্রমাণ যা প্রত্যেক বাতিলের অনুসারীর (আহলুল বাতিল)—হোক বিদআতি বা প্রকাশ্য পাপাচারী—সাথে বসা নিষিদ্ধ করে, যতক্ষণ তারা তাদের মিথ্যা কথা জারি রাখে।” ইবনু আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন: “প্রবৃত্তির অনুসারীদের (আহলুল আহওয়া) সাথে বসো না। কারণ, তাদের মজলিসগুলো অন্তরে রোগের কারণ।”

সুতরাং মুমাইয়ি  (আপসকামী) ব্যক্তি বিদআতিদের সাথে আপস করতে চায়, সে সত্যের বিকৃতিকারীদের প্রতি ক্ষোভ দেখাতে অনিচ্ছুক—এবং এর ফলাফল হলো আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহর যুবসমাজের পথভ্রষ্টতা, যারা তার আচরণকে অনুসরণীয় উদাহরণ হিসেবে নিতে পারে। তাই, যদি কোনো বাতিলের অনুসারী সামনে আসে, আমাদের প্রতিক্রিয়া কী হবে? তা হলো: তাকে দাওয়াহ দেওয়া, উপদেশ দেওয়া এবং সত্যটা তার সামনে ব্যাখ্যা করা। এরপরও যদি সে অস্বীকার করে? তখন (জবাবে) আল্লাহ বলেন: “হে নবি! কাফির ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করুন, তাদের প্রতি কঠোর হোন।” [সূরা আত-তাওবাহ, ৯:৭৩] আহলুস সুন্নাহ এই আয়াতটি মুনাফিকদের প্রতি কঠোরতার পাশাপাশি বিদআতি ও আহলুল আহওয়ার ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করে, কারণ তাদের মধ্যে মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান।

বিদআতিদের দিক থেকে ইসলামের অনুসারীদের জন্য যে বিপদ সৃষ্টি হয় তা প্রকাশ্য কাফিরদের বিপদের চেয়েও বেশি গুরুতর। এসব সুন্নাহর মহান উলামাদের কাছে প্রতিষ্ঠিত নীতি। আর আহলুস সুন্নাহর জন্য মুমাইয়িদের (বিদআতিদের সাথে মিশে যাওয়া শিথিলপন্থি) পক্ষ থেকে সৃষ্ট ঝুঁকি প্রকাশ্য ও সুস্পষ্ট বিদআতিদের চেয়েও বেশি ভয়াবহ। আমরা বিদআতিদের চিনি এবং আল্লাহর ইচ্ছায় তাদের বিরুদ্ধে সতর্ক করি।

যে ব্যক্তি বিদআতিদের জন্য অজুহাত তৈরি করে ও তাদের প্রতি ছাড় দেয়, সে আহলুস সুন্নাহর জন্য বিপজ্জনক। আমরা বলি: তোমাদের ও আমাদের মধ্যে সুন্নাহর প্রতিষ্ঠিত সহিহ গ্রন্থসমূহ বিদ্যমান। যদি সালাফিদেরকে সেগুলোর কোনো একটি শব্দেরও বিরোধিতা করতে দেখো, আমাদের সামনে উপস্থাপন করো। আমি আপনাদের কাছে এ বিষয়ে কিছু আসার বর্ণনা করবো—যদিও আজকের মুমাইয়িরা, যারা বিদআত ও বিদআতিদের প্রতি শিথিল, পছন্দ করে না যে এ ধরনের বর্ণনার প্রচার হোক। নিম্নোক্ত বক্তব্য ইমাম আল-লালিকাঈ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর বিশাল গ্রন্থের প্রথম খণ্ড থেকে নেওয়া হয়েছে, যেখানে তিনি আর-রাযিয়াইনের, আবু হাতিম ও আবু যুরআহ, আকিদাহ-বিশ্বাসের কথা উল্লেখ করেছেন। এরপর তিনি আবু হাতিমের (রাহিমাহুল্লাহ) আকিদাহর ব্যাপারে পাওয়া কথার বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখেন: “আল-কারাবিসির ব্যাপারে আহলুল হাদিস ওয়াস সুন্নাহর  সতর্কতা।” এই কারাবিসি ছিলেন একজন প্রখ্যাত ফকিহ ও আলিম। পরে তিনি তাদলিস (ইসনাদের বিশুদ্ধতা দেখাতে হাদিসের সনদে দুর্বলতা গোপন করা) সম্পর্কিত একটি বই লেখেন, যেখানে তিনি মুদাল্লিসিনদের  (যারা সনদের ত্রুটি গোপন করে) নাম উল্লেখ করেন। বইটি ইমাম আহমাদের নিকট পেশ করা হয়, এবং এতে ভুল পেয়ে তিনি এর সমালোচনা করেন। কারাবিসিকে বলা হলো, বইটি ইমাম আহমাদের কাছে পৌঁছেছে এবং তিনি এর সমালোচনা করেছেন, আর তিনি আপনার ভুলগুলো সংশোধনের জন্য অনুরোধ করেছেন। আল-কারাবিসি তা অগ্রাহ্য করলেন। যদিও তিনি শুরুতে বলতেন: “এটি আবু আবদিল্লাহর (আহমাদ বিন হাম্বল) কাছে নিয়ে যাও, তিনি একজন নেককার ব্যক্তি যিনি সঠিক পথে পরিচালিত হয়েছেন।” কিন্তু যখন বইটি ইমাম আহমাদের কাছে পেশ করা হলো, তিনি তা খণ্ডন করলেন, আল-কারাবিসির বিরুদ্ধে সতর্ক করলেন এবং তার সাথে না বসার নির্দেশ দিলেন!

আবু হাতিম (রাহিমাহুল্লাহ) আল-কারাবিসির বিরুদ্ধে তাঁর সতর্কতা ঘোষণা করেন এবং তার পক্ষাবলম্বনকারী যেমন–দাউদ ইবনু আলি আল-আসবাহানি, যিনি যাহিরিয়্যাহর (অক্ষরবাদী মাজহাব) ইমাম, উলামাদের কাছে যার বেশ মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান ছিল, থেকেও সতর্ক করেন। দাউদ ইবনু আলি ইমাম আহমাদের কাছে গেলে ইমাম আহমাদ তাকে নিমন্ত্রণ দেওয়া বা তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে অস্বীকার করেন। আবু হাতিম দাউদ ইবনু আলির বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর ভাষায় কথা বলেন—কারণ তিনি আল-কারাবিসির পক্ষ নিয়েছিলেন। একইভাবে, আল-কারাবিসি যখন ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বলের বক্তব্য শুনলেন, তিনি অহংকারী হয়ে উঠলেন এবং আহমাদ ইবনু হাম্বলের সমালোচনা শুরু করলেন।

দাউদ ইবনু আলি আল-কারাবিসির পক্ষ নিয়েছিলেন এবং তার জন্য অজুহাত তৈরি করেছিলেন। আহমাদ তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, গ্রহণ করেননি বা সাক্ষাৎ করতে রাজি হননি। আবু হাতিম তার বিরুদ্ধে সতর্ক করেছিলেন, আর সেই যুগের বহু উলামা তার বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন। তাহলে এযুগের এসব লোকেদের অবস্থান অতীতের সেই ব্যক্তিদের তুলনায় কোথায় দাঁড়ায়?

সুতরাং, যারা বিদআতি ও পথভ্রষ্টদের ব্যাপারে নরমপন্থি ও আপসকামী হতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে সতর্ক করা অপরিহার্য। রাসুল ()-এর বিশুদ্ধ সুন্নাহকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করা এবং সোজা, স্পষ্ট ও দৃঢ় পথ অনুসরণ করা আবশ্যক—যে পথে আল্লাহর রাসুল আমাদের রেখে গেছেন, তাঁর সাহাবাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহুম), তাবিয়িন এবং পরবর্তীতে হাদিসের ইমামগণ যেমন: আয-যুহরি, দুই সুফিয়ান (সুফিয়ান আস-সাওরি ও সুফিয়ান ইবনু উয়াইনাহ), মালিক, তাঁদের সমতুল্য যারা ছিলেন, হাসান (আল-বাসরি), ইবনু সিরিন, আইয়ুব (আস-সাখতিয়ানি), (ইউসুফ) ইবনু আসবাত, দুই হাম্মাদ (হাম্মাদ ইবনু সালামাহ ও হাম্মাদ ইবনু যাইদ), ওয়াকি, ইব্রাহিম (আন-নাখাঈ), আলকামাহ, আহমাদ ইবনু হাম্বল, আল-বুখারি, মুসলিম, আবু দাউদ, আত-তিরমিজি, ইবনু মাজাহ প্রমুখ—এই মানুষগুলোই সুন্নাহর সংরক্ষণ ও পাহারা দিয়েছিলেন, আর তাঁদের মাধ্যমেই আল্লাহ সাহাবাদের (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) বর্ণনাগুলোকে সংরক্ষণ ও রক্ষা করেন।

আজকের দিনে আলি আল-মাদিনি বা দাউদ বিন আলির (এই দুই ইমামের ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক) মতো মর্যাদাবান কে আছে, যাকে বিরোধীরা সমর্থন দিবে? আলি আল-মাদিনির (রাহিমাহুল্লাহ) বিস্তর ও গভীর ইলম থাকা সত্ত্বেও ইমাম আহমাদ তাকে রদ করেছিলেন এবং একজন বিদআতির নিকটবর্তী হওয়া ও সুন্নাহর উলামাদের সমালোচনা করার কারণে তাকে বর্জন করেছিলেন। ইমাম আহমাদ, আবু হাতিম ও অন্যান্য মহান আলিমগণ আলি আল-মাদিনি ও দাউদ ইবনু আলিকে আল-কারাবিসির ব্যাপারে তাদের প্রশংসার কারণে দূরে সরিয়ে দেন এবং তাদের বিরুদ্ধে সতর্ক করেন।

অতএব, কোথায় এখনকার সেই মুমাইয়িরা (আপসকামী), যারা মনে করে বিদআত, পথভ্রষ্টতা ও বিভ্রান্তির দিকে আহ্বানকারীদের সমর্থন করা তাদের জন্য বৈধ? আর যখন তারা বিদআতিদের আশ্রয় দেয় ও তাদের পক্ষ নেয়, তারা আশা করে যে আহলুস সুন্নাহ চুপ থাকবে।

আস-সালাফুস সালিহিনগণ আহলুল বিদআতের প্রতি তাদের অবস্থান নিয়ে কোনো সন্দেহে ছিলেন না। সাবিত বিন আজলান (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: “আমি আনাস বিন মালিক, সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িব (মৃ. ৯৪ হি.), আল-হাসান আল-বাসরি (মৃ. ১১০ হি.), সাঈদ বিন জুবাইর (মৃ. ৯৫ হি.), ইব্রাহিম আন-নাখাঈ (মৃ. ৯৬ হি.), আতা বিন আবি রাবাহ (মৃ. ১১৪ হি.), তাউস বিন কাইসান (মৃ. ১০৬ হি.), মুজাহিদ (মৃ. ১০৪ হি.), আবদুল্লাহ বিন আবি মুলাইকা (মৃ. ১১৭ হি.), আয-যুহরি বিন শিহাব (মৃ. ১২৪ হি.), মাকহুল আশ-শামি (মৃ. ১১২ হি.), আল-কাসিম আবু আবদির রহমান, আতা আল-খুরাসানি (মৃ. ১৩৫ হি.), সাবিত আল-বুনানি (মৃ. ১২০ হি.), আল-হাকাম বিন উতাইবাহ, আইয়ুব আস-সাখতিয়ানি (মৃ. ১৩১ হি.), হাম্মাদ, মুহাম্মাদ বিন সিরিন (মৃ. ১১০ হি.), আবু আমির, যিনি আবু বকর আস-সিদ্দিকের (রাদিয়াল্লাহু আনহু) সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন, ইয়াজিদ আর-রিকাশি (মৃ. ১১৯ হি.) ও সুলাইমান বিন মুসার সাথে সাক্ষাৎ করেছি। তাদের সবাই আমাকে জামাআহকে আঁকড়ে ধরতে এবং ভ্রান্ত প্রবৃত্তির অনুসারী (আহলুল আহওয়া) থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন।”

সুতরাং, আহলুস সুন্নাহর মানহাজ মূলত আহলুল বিদআতের সাথে বসা, তাদের সাথে আপস করা, মেলামেশা করা বা একই মঞ্চে অংশগ্রহণ করা থেকে নিষেধ করে। তার চেয়ে গুরুতর হলো তাদের প্রশংসা করা ও সাহায্য করা, পক্ষান্তরে আহলুস সুন্নাহ ও তাঁদের আলিমদের বিরোধিতা করা। সত্যের প্রতি আনুগত্যের অর্থ হলো সত্যের অনুসারীদের প্রতি আনুগত্য—তাদের সাহায্য ও সমর্থন করা। আবু উসমান ইসমাঈল আস-সাবুনি (রাহিমাহুল্লাহ, মৃ. ৪৪৯ হি.) বলেন: “আহলুস সুন্নাহর একটি স্বতন্ত্র নিদর্শন হলো সুন্নাহর ইমাম, এর উলামা, সাহায্যকারী ও মিত্রদের প্রতি তাঁদের ভালোবাসা—এবং অনুরূপভাবে বিদআতের ইমাম ও জাহান্নামের দিকে আহ্বানকারীদের প্রতি তাদের ঘৃণা।”

কিছু লোক বিদআতিদের সম্মান ও প্রশংসা করার মাধ্যমে যখন সালাফিয়্যাহর এই মৌলিক নীতিমালার লঙ্ঘন ও বিরোধিতা করে, অথচ একই সাথে আহলুস সুন্নাহ, তাঁদের উলামা ও তাঁদের গ্রন্থসমূহের দোষত্রুটি খুঁজে বেড়ায়, তখন এমন বাতিল ও বিশ্বাসঘাতকতার সামনে আহলুস সুন্নাহ নিশ্চুপ থাকতে পারে না।

সমাপ্ত।

সোর্স: abukhadeejah.com

ফুটনোট:
[১] ইবনু রজবের শারহু ইলাল আত-তিরমিজি, ১/২১৫
[২] তাবাকাতুল হানাবিলাহ, ১/২২৭
[৩] তাবাকাতুল হানাবিলাহ, ১/২২৭
[৪] ইবনু রজবের শারহু ইলাল আত-তিরমিজি, ১/২১৬
[৫] দেখুন: আবু ইয়ালার তাবাকাতুল হানাবিলাহ, ২/২৮৯; তাহরিম আন-নাযর ফি কুতুবিল কালাম, পৃ. ৬০
[৬] তাবাকাতুল হানাবিলাহ, ১/১৪৮
[৭] তাবাকাতুল হানাবিলাহ, ১/১৪৬
পরবর্তী পোস্ট পূর্ববর্তী পোস্ট
কোনো কমেন্ট নেই
কমেন্ট করুন
comment url