ইয়াসির কাদির খণ্ডন—শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব ও সালাফি উলামাদের বিরুদ্ধে তার দীর্ঘ অপবাদমূলক বক্তব্য—আহলুল বিদআহর প্রশংসা, আহলুস সুন্নাহর নিন্দা, মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে প্ররোচণা এবং অন্যান্য বিদআত
.gif)
১. একজন সুন্নাহর ইমামের বিরুদ্ধে ইয়াসির কাদির অপবাদমূলক অর্থহীন দীর্ঘ সমালোচনা
ইয়াসির কাদি, সাম্প্রতিক একটি ভিডিয়োতে, ইবনু তাইমিয়্যাহ (মৃ. ৭২৮হি.) ও ইবনু আব্দুল ওয়াহহাবের (মৃ. ১২০৬হি.) মধ্যকার পার্থক্য নিয়ে অভিভূত মুখে তার হাত নেড়েচেড়ে এমনভাবে কথা বলছিল যেন নতুন কোনো বিষয় আবিষ্কার করে ফেলেছে। প্রথম সেকশনে শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাবের (রাহিমাহুল্লাহ) বিরুদ্ধে তার বানোয়াট ও সুস্পষ্ট মিথ্যা দাবিগুলো তুলে ধরা হয়েছে।
ইয়াসির কাদির দাবি, “তাদের দুজনের মাঝে গভীর পার্থক্য বিদ্যমান। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হলো, ইবনু তাইমিয়্যাহ তার বিরোধীদেরকে ঐ কাজের জন্য তাকফির করতেন না যে কাজ ইবনু আব্দুল ওয়াহহাবের বিরোধীরাও করতো, আর তিনি তাদের তাকফির করেছিলেন এবং তাদের রক্তপাত হালাল (হালাল আদ-দাম্ম) করেছিলেন।”
এক মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যেই, কাদি বলে ওঠে, ইবনু আব্দুল ওয়াহহাব নিজেকে মনে করতেন, “দুনিয়ার একমাত্র মুসলমান… এটা এক স্তরের অন্ধ গোঁড়ামি (Fanaticism) ও তাকফির, এক স্তরের নব্য-খারিজিবাদ যা স্বাভাবিকভাবেই আমি মেনে নিতে পারি না। নিজেকে ছাড়া পুরো উম্মাহকে কাফির ও মুশরিক সাব্যস্ত করা মূলধারার ইসলাম নয়…”
এরপর, এই আলিমের ওপর একের পর এক পুরোদস্তুর অপবাদ দেওয়ার পর, সে চলে যায় আহলুল বিদআতের প্রতি তার ভালোবাসা ও সম্মান জাহির করতে। কাদি বলে: “একজন আশআরি বা মাতুরিদি, বা একজন তাবলিগি, বা একজন দেওবন্দি, বা জামাতি, বা একজন ইখওয়ানির বিরুদ্ধে আমার অন্তরে এখন কোনো নেতিবাচকতা বা বিদ্বেষ নেই। এসব দলগুলোর সবটাতেই ভালো গুণ রয়েছে, সবার মধ্যেই। তাদের কিছু খারাপ দিকও থাকতে পারে…” [১]
২. শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাবের মুসলিমদের তাকফির সংক্রান্ত অবস্থান
তাওহিদ ও সুন্নাহর শত্রুরা মহান এই আলিম, যুগের মুজাদ্দিদ ও শাইখুল ইসলাম মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহহাবের (আল্লাহ তাঁর ওপর রহম করুন) বিরুদ্ধে যে মিথ্যা অভিযোগ উত্থাপন করে, তার মধ্যে অন্যতম হলো—তিনি অযৌক্তিকভাবে মুসলিমদের তাকফির করেছেন এবং সমগ্র উম্মাহকে কাফির আখ্যা দিয়েছেন, এমনকি দাবি করেছেন যে তিনি ও তাঁর অনুসারীরা ছাড়া পৃথিবীতে কোনো মুসলিম নেই। এই মিথ্যা অভিযোগকে এখন পুনরায় উস্কে দিয়েছে এই কপট বিভ্রান্ত বিদআতি, ইয়াসির কাদি। ইসলাম নিয়ে প্রাচ্যবিদদের (Orientalists) সংকীর্ণমনা ব্যাখ্যা যা ইসলামের বিশুদ্ধতাকে কলঙ্কিত করার এবং আম্বিয়া ও আহলুল হাদিসদের মানহাজের প্রতি সন্দেহ সৃষ্টিকারী মতামত বৃদ্ধির প্রচেষ্টায় লিপ্ত, তাদের সেই নর্দমা থেকে বছরের পর বছর ধরে পান করতে থাকা কাদি এখন ইসলামের শত্রুদের বুলি আওড়াচ্ছে এবং আহলুত তাওহিদ ওয়াস সুন্নাহর বিরুদ্ধে তাদের পক্ষ হয়ে লড়াই করছে। কাদি দাবি করে যে, শাইখুল ইসলাম ইবনু আব্দুল ওয়াহহাব সমগ্র উম্মাহকে তাকফির করেছেন, কাউকেই বাদ দেননি! নিজেই এবার মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাবের বক্তব্য পড়ুন এবং বিচার করুন। শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহহাব বলেছেন:
১. “আমরা যদি আব্দুল কাদিরের (আল-জিলানি) মাজারের পূজারি কিংবা আহমাদ আল-বাদাওয়ি প্রমুখের মাজারের উপাসনাকারীদেরকে তাদের অজ্ঞতার কারণে, এবং তাদেরকে (তাদের ভুল) দেখিয়ে দিবে এমন কারো অনুপস্থিতি থাকার কারণে তাকফির না করি, তাহলে কীভাবে সম্ভব আমরা ঐসব লোকদের তাকফির করবো যারা আল্লাহর সাথে শির্ক করে না অথবা আমাদের দিকে হিজরত করে আসে না... হে আল্লাহ! আপনি সকল ত্রুটি থেকে পবিত্র, পরিপূর্ণ। নিশ্চয়ই এটি এক মহা মিথ্যা অপবাদ।” [২]
২. সুলাইমান ইবনু সুহাইম নামক এক ব্যক্তি শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহহাবের বিরুদ্ধে তাকফিরের মিথ্যা অভিযোগ আনার পর তিনি জবাবে বলেন: “নিশ্চয়ই আল্লাহ জানেন, এই ব্যক্তি আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে, এমন সব কথা আমার নামে চাপিয়েছে যা আমি কখনো বলিনি, এমনকি যার কিছু আমার মাথায়ও আসেনি! এর মধ্যে রয়েছে—তার দাবি যে আমি চার মাযহাবের কিতাবগুলোকে বাতিল বলি এবং তার দাবি, আমি বলি, গত ৬০০ বছর ধরে লোকেরা (উম্মাহ) কোনোকিছুর (কোনো ইসলামের) ওপর ছিল না! আর আমি নাকি পুণ্যবানদের (যারা ইন্তেকাল করেছেন) মাধ্যমে তাওয়াসসুলকারীকে (আল্লাহর নৈকট্য কামনা) তাকফির করি। সে আরও দাবি করে যে আমি আল-বুসাইরিকে তাকফির করেছি… এবং আমি নাকি বলেছি, যে ব্যক্তিই আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে শপথ করে, আমি তাকে কাফির বলি… এসবের ব্যাপারে আমার জবাব হলো: ‘হে আল্লাহ! আপনি সকল দোষ থেকে পবিত্র, পরিপূর্ণ। নিশ্চয়ই এটি এক মহা মিথ্যা অপবাদ।’ এ ধরনের মিথ্যা অভিযোগ আগেও ছিল। রাসুল মুহাম্মাদের (ﷺ) বিরুদ্ধেও অপবাদ দেওয়া হয়েছিল যে তিনি মরিয়মপুত্র ঈসাকে (আলাইহিস সালাম) গালমন্দ করতেন এবং নেককারদের অবমাননা করতেন। সুতরাং, মিথ্যা রটনা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের অন্তরগুলো একই।” [৩]
তো, এসব শাইখুল ইসলাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাবের (রাহিমাহুল্লাহ) সুস্পষ্ট বক্তব্য। এই স্যুডো-অ্যাকাডেমিক (Pseudo-academic) ইয়াসির কাদির মিথ্যা ও মনগড়া দাবিগুলোর সাথে এর তুলনা করুন, যে তাওহিদ ও সুন্নাহর শত্রুদের হাতের খেলনা মাত্র।শাইখুল ইসলাম মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহহাব (রাহিমাহুল্লাহ) আরও বলেন:
“আমি কোনো মুসলিম ব্যক্তির ব্যাপারে (নাম ধরে) সাক্ষ্য দিই না যে সে (নিশ্চিতভাবেই) জান্নাতি বা জাহান্নামি—যদি না রাসুলুল্লাহ (ﷺ) তার ব্যাপারে সাক্ষ্য দেন। তবে আমি নেককারদের ব্যাপারে আশাবাদী এবং গুনাহগারদের ব্যাপারে শঙ্কিত। আর আমি কোনো মুসলিমকে গুনাহের কারণে কাফির বলি না, তাকে ইসলামের গণ্ডি থেকেও বের করে দিই না।” [৪]
৩. কাদির আহলুল বিদআতের প্রশংসা ও আহলুস সুন্নাহর (আস-সালাফিয়্যুন) প্রতি বিদ্বেষ ও অবমাননা এবং তাদেরকে “মাদখালি কাল্ট” বলে কটাক্ষ
কাদি আহলুল বিদআতের প্রতি তার মুগ্ধতা প্রকাশ করে বলে: “আমার অন্তরে একজন আশআরি, মাতুরিদি, তাবলিগি, দেওবন্দি, জামাতি বা ইখওয়ানির বিরুদ্ধে কোনো নেতিবাচকতা নেই। এসব দলের সবটাতেই ভালো গুণ রয়েছে। অবশ্য তাদের কিছু খারাপ দিকও থাকতে পারে...”
বেশ সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে (জুন ২০২০) সে সালাফিদের বিরুদ্ধে নিম্নোক্ত বিদ্বেষপূর্ণ অভিযোগসমূহ তোলে:
- সালাফিদের “মাদখালি কাল্ট” বলে কটাক্ষ করা, যারা শাইখ রাবি আল-মাদখালির অনুসারী।
- দাবি করে যে, শাইখ মুহাম্মাদ আমান আল-জামি এবং এরপর “তাঁর ছাত্র” শাইখ রাবি, তার দাবি অনুযায়ী, একটি নতুন আন্দোলনের সূচনা করেছেন।
- “মাদখালি কাল্টের” সদস্য হতে হলে (সৌদি আরবের) বাদশাহকে অন্ধভাবে অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক।
- সালাফিরা “মূলধারার ইসলামের” অনুসারী নয়।
- শাইখ উবাইদ আল-জাবিরি এই মাদখালি কাল্টের একজন আলিম
- “ইবনু তাইমিয়্যাহর জীবনী অধ্যয়ন করে কেউ কীভাবে মাদখালি হতে পারে?!”
- সে দাবি করে যে সালাফিরা শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহর শিক্ষা থেকে যোজন-যোজন দূরে।
কাদি, আবারো গতানুগতিক ধাঁচে, “সাহওয়া উলামা” নামে পরিচিত বিদ্রোহী কুতুবিপন্থি (Qutubists) বিদআতি, সাফার আল-হাওয়ালি ও সালমান আল-আওদাহর প্রশংসা করে এবং মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে তাদের বিপ্লবী বক্তব্যের বৈধতা দেয়।
পুরো এই সাক্ষাৎকারটি মিথ্যা, ভিত্তিহীন অভিযোগ, ট্যাগিং, অবমাননা ও তিরষ্কারে পরিপূর্ণ। এরপর সে (আইরনিক্যালি) মুসলিমদের পরস্পরকে খণ্ডন করা ও সমালোচনা থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেয়!
ইন্টারভিউর শেষে সে আহলুল বিদআতের নিদারুণ প্রশংসা করে এবং মুসলিমদেরকে ইসলামি চিন্তার “বিভিন্ন ধারার” কাছ থেকে —সুফি, দেওবন্দি, ইখওয়ানি ইত্যাদি—জ্ঞানার্জন করতে উপদেশ দেয়, অবশ্যই সালাফিরা বাদে, যেহেতু সে পুরো ইন্টারভিউটি তাদের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ হয়ে এবং তাদের খণ্ডনে ব্যয় করেছে। [৫]
৪. ইয়াসির কাদির আহলুল বিদআতের প্রশংসা ও আহলুস সুন্নাহর (আস-সালাফিয়্যুন) প্রতি বিদ্বেষের জবাব
তিনি জবাব দেন:
আল্লামাহ সালিহ আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন: “যদি তুমি দেখো কোনো ব্যক্তি অকল্যাণের অনুসারী ও পথভ্রষ্ট উলামাদের – যেমন: জাহমিয়্যাহদের শাখাগত দল – প্রশংসা করছে, তবে জেনে রাখো যে সে নিজেও একজন গুনাহগার (ফাসিক), অসৎ ও পথভ্রষ্ট লোক। কারণ, সে তাদের ভালোবাসা ও তাদের পন্থার সমর্থন করা ও মেনে নেওয়ার জন্যই এমন করে। আর যদি কাউকে আহলুস সুন্নাহর প্রশংসা করতে দেখো, যেমন - ইমাম আহমাদ (মৃ. ২৪১হি.), ইবনুল মুবারাক (মৃ. ১৮১হি.), এবং অনুরূপ তাবিয়িনদের উলামা এবং তাঁদের পরে যারা এসেছেন তাঁদের, তবে জেনে রাখো, সে ব্যক্তি কল্যাণের অনুসারী। কারণ, সুন্নাহর প্রতি তার ভালোবাসা ও একে আঁকড়ে ধরার জন্যই সে তা করে।
সুতরাং, এটা আমাদের জন্য একটি শিক্ষা। কিছু কিছু ভাই বা তালিবুল ইলম কোনো বিদআতি বা আহলুল আহওয়া (প্রবৃত্তি বা খেয়ালখুশির অনুসারী) এবং বিভ্রান্ত মতবাদ আছে এমন কারো প্রশংসা করে বসে। তো সে (এই ছাত্র) তাদের মতবাদ ও চিন্তাধারা যাচাই করতে ব্যর্থ হয় এবং এভাবে খাইরের অনুসারীদের আক্রমণ করাতে পতিত হয় এবং তাদেরকে ছোট করে। এর কারণ হলো, তারা (আহলুল বিদআতের) কাছ থেকে কল্যাণের অনুসারীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ শুনে এবং তা বিশ্বাস করে নেয়।
এটি এক ভয়াবহ বিপদ যে, কোনো ব্যক্তি নেককার মানুষদের হেয় প্রতিপন্ন করে, উলামা ও আহলুস সুন্নাহর অবমাননা করে, অথচ বিপথগামী চিন্তাধারা ও আদর্শের প্রশংসা করে—এটা ভয়াবহ বিপদ! এমনকি যদি সে নিজে সরাসরি বিদআতিদের সাথে না বসে তবুও! আল-বারবাহারি আমাদের এ থেকেই সতর্ক করেছেন—এই বিষয়টি, যেটায় আমাদের যুগের বহু লোক পতিত হয়েছে।” [৭]
রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বিদআতিদের থেকে সতর্ক করেছেন, তাদের সাথে বন্ধুত্ব করা, তাদেরকে সমর্থন দেওয়া বা তাদের কাছ থেকে গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন: “যে ব্যক্তি বিদআত করে অথবা বিদআতিকে আশ্রয় দেয়, তার ওপর আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাগণ ও সমগ্র মানবজাতির লানত বর্ষিত হয়।” [৮]
ইয়াহইয়া ইবনু কাসির বলেন: “সুলাইমান বিন দাউদ (আলাইহিস সালাম) বলেছেন: ‘কাউকে বিচার করার আগে দেখো সে কার সাথে বন্ধুত্ব করে।” [৯]
আল্লাহর রাসুল (ﷺ) বলেন:
আল্লাহ তাআলা বলেন:
ইমাম তাবারি (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর তাফসিরে (৫/৩৩০) বলেছেন: “এ আয়াতটি সকল প্রকার বাতিলপন্থী (আহলুল বাতিল)—হোক বিদআতি (মুবতাদিআহ) কিংবা প্রকাশ্য পাপাচারী—যারা মিথ্যাচারে লিপ্ত, তাদের সাথে ওঠাবসা নিষিদ্ধ হওয়ার সুস্পষ্ট প্রমাণ যতক্ষণ তারা তাদের মিথ্যাচারে বহাল থাকে।”
ইবনু আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেছেন: “প্রবৃত্তির অনুসারীদের (আহলুল-আহওয়া) সাথে বসো না। কারণ তাদের মজলিসগুলো অন্তরে রোগ সৃষ্টির কারণ।”
তাই, আহলুস সুন্নাহর মানহাজ এর সূচনা থেকে আহলুল বিদআতের সাথে বসা, তাদেরকে আশ্রয় দেওয়া, মেলামেশা করা বা একই প্ল্যাটফর্মে অংশ নেওয়া থেকে নিষেধ করে। এর চেয়েও মারাত্মক হলো তাদের প্রশংসা করা ও সাহায্য করা, পক্ষান্তরে আহলুস সুন্নাহ ও তাদের উলামাদের বিরোধিতা করা। সত্যের প্রতি আনুগত্য সত্যের অনুসারীদের প্রতি আনুগত্যকে অপরিহার্য করে—তাদের সাহায্য করা ও সমর্থন করা। আবু উসমান ইসমাঈল আস-সাবুনি (রাহিমাহুল্লাহ, মৃ. ৪৪৯হি.) বলেন: “আহলুস সুন্নাহর অন্যতম স্বতন্ত্র নিদর্শন হলো—তাঁরা সুন্নাহর ইমাম, আলিম, সহযোগী ও মিত্রদের ভালোবাসে। পাশাপাশি তাঁরা বিদআতের ইমামদের ঘৃণা করে যারা জাহান্নামের দিকে ডাকে।”
পড়ুন: যারা আহলুল বিদআতের প্রতি নরম এবং আহলুস সুন্নাহর প্রতি কঠোর তাদের ব্যাপারে একজন সুন্নির অবস্থান
শাইখ ইবনু উসাইমিনকে (رحمه الله) প্রশ্ন করা হয়: “যে ব্যক্তি এই দাবিতে শাইখ রাবি বিন হাদির ক্যাসেটগুলো (এর প্রচার-প্রসার) থেকে নিষেধ করে যে, এসব ফিতনাহর সৃষ্টি করছে এবং এসব মামলাকার উলাত আল-উমুরের (সৌদি শাসকদের) প্রশংসাপূর্ণ, আর তাদের প্রশংসা তার নিফাক (মুনাফেকি) থেকে নির্গত, তার ব্যাপারে আপনার কী উপদেশ?” শাইখ জবাব দেন: “আমরা এটাকে বড়ো ভুল ও ভ্রান্তি মনে করি। শাইখ রাবি সুন্নাহর উলামা এবং আহলুল খাইরদের (কল্যাণের অনুসারী) একজন। তাঁর আকিদাহ শুদ্ধ, তাঁর মানহাজ বিশুদ্ধ ও বলিষ্ঠ। তবে, যখন তিনি পরবর্তী কিছু লোকের প্রতীকী ব্যক্তিত্বের (Symbolic figureheads) ব্যাপারে কথা বলা শুরু করেন, তারা তাঁকে এই দোষে কলঙ্কিত করতে আরম্ভ করে।” [১১]
৫. মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে ইয়াসির কাদির বিদ্রোহী ইখওয়ানি-খারিজি কুতর্ক
“শাইখ সাফার আল-হাওয়ালি এবং তার আগে শাইখ সালমান আল-আওদাহসহ অন্যান্য আলিমদেরকে সৌদি আরবের নতুন যুবরাজ কর্তৃক গ্রেফতারের সাম্প্রতিক ঘটনাটি স্বৈরাচারী ও অত্যাচারী শাসকদের বৈশিষ্ট্যসূচক ম্যাকিয়াভেলীয় চর্চার বেশ পুরোনো কৌশলের একটি চিত্র। ম্যাকিয়াভেলি, যাকে সাধারণত স্বৈরতন্ত্র ও রাজনৈতিক প্রতারণার দার্শনিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তিনি লিখেছিলেন যে, একজন শাসকের পক্ষে প্রিয় হওয়ার চেয়ে ভীতিকর হওয়াই উত্তম। আর মনে হচ্ছে বর্তমান এই বালক-যুবরাজেরও (Boy-prince) যেন এটাই খায়েশ...”

কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমার বিরুদ্ধে এবং হাদিস ও সুন্নাহর প্রধান উলামাদের ফাতওয়ার বিপরীতে ইয়াসির কাদি এও বলেছে: [১২]
“আমি সুস্পষ্টভাবে বলছি: আল্লাহই আমার সাক্ষী, মিশরে এসব বিক্ষোভের খবর শুনে এবং তিরিশ বছর ধরে চলা পুতুল রেজিমের বিরুদ্ধে ইতিবাচক পরিবর্তন কামনায় রাস্তায় নেমে আসা মিশরীয় জনতার ঢল, ট্যাংকের মুখে তাদের শরীর দিয়ে মোকাবেলা করা, সৈন্যদের সামনে আল্লাহর প্রতি সিজদাবনত হওয়া, ওয়াটার গান দ্বারা সিক্ত হওয়া সত্ত্বেও—এমন দৃশ্য দেখে আমার হৃদয় আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছে। কোনো মুমিনের হৃদয় কীভাবে উচ্ছ্বসিত না হয়ে পারে, যখন সে দেখে সাধারণ মুসলমানরা তাদের নিপীড়ক শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে কতোটা সাহসিকতার সাথে রুখে দাঁড়াচ্ছে যাদের অধীনে তারা বসবাস করছিল?”
৬. মুসলিম শাসক ও সরকারদের প্রতি ইয়াসির কাদির নিন্দার জবাব
নবি (ﷺ) সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন হাদিসে নিন্দা, উত্তেজনা সৃষ্টি ও বিদ্রোহ করতে নিষেধ করেছেন। এসব হাদিসকে কখনোই ব্যক্তির ইচ্ছা, মতামত, যুক্তি বা মানুষদের চোখে মর্যাদাবান ব্যক্তিদের ভুল সিদ্ধান্তের বিপরীতে দাঁড় করানো যায় না। রাসুল (ﷺ) ওয়াহির ভিত্তিতে কথা বলেছেন, আর তাঁর পরবর্তী লোকেরা বলেননি। একারণে ইজমা (ঐকমত্য) প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর খাওয়ারিজ, শিয়া, মুতাযিলা ও তাদের শাখাগত দলগুলো ছাড়া কেউই এর বিরোধিতা করেনি। বর্তমান সময়ে ইয়াসির কাদি ও তার অনুসারীরাও এই দলভুক্ত।
মুসলিম তাঁর সহিহে (১৮৪৭) ওয়াইল ইবনু হুজর থেকে বর্ণনা করেন: সালামাহ ইবনু ইয়াযিদ আল-জুফি রাসুলুল্লাহকে (ﷺ) জিজ্ঞেস করেন, “হে আল্লাহর নবি! আমাদের ওপর যদি এমন শাসক নিযুক্ত হয় যারা নিজের অধিকার চায় কিন্তু আমাদের অধিকার দেয় না, তখন আমরা কী করবো?” তিনি উত্তর দিলেন, “তাদের কথা শুনবে ও মানবে (যা-হোক)। তাদের বোঝা তাদের ওপর, আর তোমাদের বোঝা তোমাদের ওপর।”
শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, “জালিম শাসকের জুলুমে ধৈর্যধারণ করা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহর মূলনীতির (আসল) অন্তর্ভুক্ত।” [১৩] আর ইবনু তাইমিয়্যাহর এ বক্তব্য রাসুল (ﷺ)-এর হাদিসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
ইবনু আবি আসিম আস-সুন্নাহয় (২/৫০৮) আদি ইবনু হাতিম (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণনা করেন: আমরা বললাম, “হে আল্লাহর রাসুল, আমরা আপনাকে মুত্তাকি (যে নেককার ও আল্লাহভীরু), ভালো ও সংশোধনকারী শাসকের আনুগত্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছি না। বরং আমরা এমন শাসক সম্পর্কে জানতে চাই যারা এই এই কাজ করে?” এভাবে তিনি তাদের মন্দ বৈশিষ্ট্যগুলো উল্লেখ করলেন। নবি (ﷺ) বললেন, “আল্লাহকে ভয় করো! শাসকের কথা শুনো ও তার আনুগত্য করো।” [১৪]
ইমাম আল-আজুররি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: “তো, এটা সম্ভব যে শাসক তোমাকে এমন ব্যক্তিকে হত্যা করার নির্দেশ দেয় যে হত্যার যোগ্য নয়, বা এমন ব্যক্তির অঙ্গচ্ছেদ করতে বলে যে তার হকদার নয়, কিংবা এমন ব্যক্তিকে প্রহার করতে বলে যাকে প্রহার করা নাজায়েয, অথবা কারো সম্পদ কেড়ে নিতে বলে যার সম্পদ নেওয়ার হক নেই, বা কারো প্রতি অন্যায় করতে বলে যার প্রতি অন্যায় করা তোমার জন্য জায়েয নেই—তাহলে এসব বিষয়ে তার আনুগত্য করো না। আর যদি সে তোমায় বলে, ‘আমি যার আদেশ দিয়েছি তা যদি তুমি না মানো, আমি তোমাকে হত্যা করবো অথবা শাস্তি প্রদান করবো!’ জবাবে বলো: ‘আমার রক্ত, আমার দ্বীন নয়।” তো এখানে উমার (রাদিয়াল্লাহু আনহু) শাসক যদি পাপাচার ও আল্লাহর অবাধ্যতার আদেশ দেয়, তাহলে তার অবাধ্য হতে বলেছেন, আর একইসাথে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা বা তার অধীনে মুসলিমদের জামাআত ত্যাগ করতে নিষেধ করেছেন। এতে আল-আজুররি শাসকের আনুগত্যের ক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাহর মানহাজ স্পষ্ট করেছেন। [১৬]
শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) (মৃ. ৭২৮হি.) বলেন: “আবদুল্লাহ ইবনু উমার, সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িব, আলি ইবনুল হুসাইন (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-সহ মুসলিমদের অন্যান্য সর্বোত্তম ও শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিবর্গ ফিতনাহর সময়ে বিদ্রোহ (খুরুজ) ও যুদ্ধ করতে নিষেধ করেছেন। তারা (মদিনাবাসীদেরকে) হাররার বছরে ইয়াযিদ ইবনু মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে বারণ করেছিলেন, যেভাবে আল-হাসান আল-বাসরি, মুজাহিদ প্রমুখ ইবনুল আশআসের ফিতনার সময় (হাজ্জাজের বিরুদ্ধে) বিদ্রোহ করতে নিষেধ করেছিলেন। সুতরাং, নবি (ﷺ)-এর সহিহ হাদিসের ভিত্তিতে আহলুস সুন্নাহর নীতি প্রতিষ্ঠিত হলো—ফিতনাহর সময় যুদ্ধ পরিত্যাগ করা। তাই আহলুস সুন্নাহ তাদের আকিদাহয় এসব হাদিস উল্লেখ করেছেন, শাসকের জুলুমে ধৈর্যধারণ করতে এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করতে নির্দেশ দিয়েছেন। (পূর্বের) বহু ইলমি ও নেককার ব্যক্তিবর্গ কর্তৃক ফিতনাহর সময় যুদ্ধ করার কথা এলেও এ নীতি প্রতিষ্ঠিত হয়।” [১৭]
শাইখুল ইসলাম আল-মুজাদ্দিদ মুহাম্মাদ ইবনু আবদুল ওয়াহহাব (রাহিমাহুল্লাহ) (মৃ. ১২০৬হি.) বলেন: “সকল মাযহাবের ইমামগণ ঐকমত্যে পৌঁছেছেন যে, যে ব্যক্তি কোনো ভূমি বা অঞ্চলসমূহ জয় করে, সে সকল ক্ষেত্রে শাসকের ভূমিকার মর্যাদা পাবে। আর এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। যদি তা না হতো, তবে দুনিয়াবি বিষয়-আশয় অস্থিতিশীল হয়ে পড়তো। আর মানুষ দীর্ঘ সময় থেকে আজ পর্যন্ত একজন নেতার অধীনে ঐক্যবদ্ধ হয়নি। এবং এটা জানা যায় না যে কোনো আলিম এ কথা বলেছেন যে, শরিয়াহ আইন কেবল তখনই কার্যকর হবে যখন একজন শাসক সমগ্র মুসলিমদের ওপর শাসন করবে।” [১৮]
আল-আল্লামাহ ইবন আল-উসাইমিন (রাহিমাহুল্লাহ) (মৃ. ১৪২০হি.) বলেন: “সালাফরা এই আকিদাহর ওপর ঐক্যবদ্ধ ছিলেন যে, নেক বা ফাসিক—সকল প্রকার শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা হারাম।” [১৯]
সুমহান আলিম, আল-ইমাম ইবনু বাযকে (রাহিমাহুল্লাহ) জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: “মিম্বার থেকে শাসকদের সমালোচনা করা কি সালাফদের মানহাজ? আর শাসকদের নাসিহাহ করার ক্ষেত্রে সালাফদের মানহাজ কী?” তিনি উত্তর দেন:
“মিম্বার থেকে শাসকদের সমালোচনা করা সালাফদের মানহাজের অন্তর্ভুক্ত নয়, কারণ এতে বিশৃঙ্খলা উস্কে দেওয়া হয় এবং যা কল্যাণকর তা শোনা ও এর আনুগত্যশীল হওয়ার ক্ষেত্রে বিঘ্ন ঘটায়। এটা ক্ষতিকর ও অলাভজনক বিষয়ে জড়িয়ে পড়ার সমতুল্য। তবে সালাফদের অনুসৃত নাসিহাহর পদ্ধতি ছিল শাসককে চিঠি লেখা বা উলামাদের মাধ্যমে তাঁর কাছে সেই নাসিহাহ পৌঁছে দেওয়া, যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি সৎপথে পরিচালিত হন। তো, মন্দের বিরোধিতা অপরাধীর নাম উল্লেখ না করেও করা যায়। তাই ব্যভিচার, মাদক ও সুদের বিরোধিতা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নাম উল্লেখ না করেও করা যায়। গুনাহের বিরোধিতা করার জন্য শুধু সেগুলো থেকে সতর্ক করাই যথেষ্ট, এটা উল্লেখ না করে যে অমুক অমুক ব্যক্তি এতে জড়িত, হোক তা শাসক বা শাসক বাদে অন্য কেউ।
আর যখন উসমান (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর সময় ফিতনাহ (পরীক্ষা, বিবাদ) সংঘটিত হয়, কিছু লোক উসামা বিন যাইদকে (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বললো, ‘আপনি কি উসমানকে নাসিহাহ করবেন না?’ তিনি জবাব দিলেন, ‘তোমরা কি মনে করো আমি তাঁকে নাসিহাহ করিনি, যেহেতু তোমরা তা আমার কাছ থেকে শুনোনি? নিশ্চয়ই আমি তাঁর সাথে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলবো, আমি এমন কোনো বিষয় উন্মুক্ত করতে অপছন্দ করি যেটার প্রথম উন্মোচনকারী হবো আমি নিজে।’ তো যখন খাওয়ারিজরা তা উন্মোচন করলো, উসমান (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর সময়ে খারাবি ছড়িয়ে পড়লো। তারা প্রকাশ্যে উসমান (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর বিরোধিতা করলো, ফলে ফিতনাহ, যুদ্ধ ও বিপর্যয় পূর্ণতা পেল—যার প্রভাব আজও মানুষকে প্রভাবিত করছে। এটাই আলি ও মুয়াবিয়াহ (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর মধ্যকার ফিতনার কারণ হয় এবং উসমান (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-কে এসব কারণেই হত্যা করা হয়…
তাছাড়া, এমন প্রকাশ্য বিদ্রোহ ও শাসকের ত্রুটি প্রচারের ফলে অসংখ্য সাহাবাহ ও অন্যান্য ব্যক্তিরা নিহত হলেন, এমনকি জনগণ কর্তৃত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে ঘৃণা করতে শুরু করলো যতক্ষণ না তারা তাকে হত্যা করলো। আমরা আল্লাহর কাছে সাফল্য কামনা করছি।” [২০]
৭. ইয়াসির কাদির বিদআত, ইসলাম নিয়ে সংশয় এবং আহলুস সুন্নাহ ও সালাফি আকিদাহর প্রতি আক্রমণ—এবং সুন্নাহর তুচ্ছতাচ্ছিল্য
এক: অমুসলিমদের সাথে ধর্মতত্ত্ব (Theology) অধ্যয়নের পর ইসলাম নিয়ে তার সংশয়
ইয়াসির কাদি বলেছে: “আমি আপনাদের প্রতি সৎ হচ্ছি, আপনারা সবাই তুল্লাবুল ইলম এবং ইসলামি সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। ওয়াল্লাহি, আমি আপনাদেরকে সততার সাথে বলছি, Yale-এ যেসব শুবুহাত (ইসলামের ব্যাপারে সন্দেহ) আমার সামনে প্রকাশিত (Exposed) হয়েছিল, সেগুলোর কিছু কিছুর উত্তর এখনও আমার জানা নেই।”
ইয়াসির কাদি সম্পর্কিত আমাদের আলোচনায় এই প্রিমিজ মেনে চলতে হবে—সে গভীর বিভ্রান্তিতে পড়ে ইসলাম ও ইসলামি আকিদাহ, কুরআন ও শরিয়াহ আইন সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে পড়ে। তাই, আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করে নিজের বুঝকে পুনর্মূল্যায়নের পরিবর্তে সে এই ভয়াবহ সংশয় ও অভ্যন্তরীণ অস্থিরতাকে আহলুস সুন্নাহর দিকে ঘুরিয়ে দিচ্ছে এবং তাদের প্রতি বিষোদগার ও ঘৃণা ছড়াচ্ছে—এমনকি তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করছে। আমরা আল্লাহর প্রশংসা করি যিনি আমাদেরকে এই পথভ্রষ্ট আত্মার ফিতনাহ থেকে হিফাযাত করেছেন।দুই: আহলুস সুন্নাহর আকিদাহ কি মানবসৃষ্ট?
ইয়াসির কাদি বলেছে: “যে আকিদাহগুলোর সাথে আমরা আবদ্ধ, সেগুলোতেও মানবসৃষ্ট উপাদান রয়েছে। সত্যি বলতে, সুন্নি ধর্মতাত্ত্বিক মাযহাবগুলো ফিকহি মাযহাবের মতোই। আমাদের বুঝতে হবে যে সত্যের সন্ধানে এসব মানুষের প্রচেষ্টা... এবং প্রতিটি [সুন্নি] মাযহাবই এক্ষেত্রে ভুল, কারণ, আকিদাহ একটি বিবর্তনশীল ধারা এবং আপনি নিজেই দেখতে পাবেন যে এটি একটি অভ্যন্তরীণ বিকাশ…”
সালাফিয়্যাহর আকিদাহ কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। আকিদার প্রতিটি নীতিই প্রামাণ্য দলিলভিত্তিক, মানুষের উদ্ভাবিত নয়—এটি রাসুলুল্লাহর (ﷺ) সাহাবিদের আকিদাহর অনুরূপ। “প্রতিটি [সুন্নি] মাযহাব”-এর আকিদাহ ভুল বলে দাবি করার অর্থ হলো, আজ নবি ও তাঁর সাহাবিদের আকিদাহর ওপর কোনো জামাআত নেই। এটি কুরআনের বহু আয়াত ও নবি (ﷺ) সহিহ হাদিসের সুস্পষ্ট বিরোধী।শাইখ সালিহ আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) ব্যাখ্যা করেন: “রাসুল (ﷺ) বলেছেন: ‘আমার উম্মাহ ৭৩ দলে বিভক্ত হবে, একটি দল বাদে সবাই জাহান্নামে যাবে, সেটাই জামাআহ।’ জিজ্ঞেস করা হলো: ‘হে আল্লাহর রাসুল, তারা কারা?’ তিনি উত্তর দিলেন: ‘যারা আজ আমার ও আমার সাহাবিদের পথে রয়েছে।’ সুতরাং এটাই সঠিক পথ: যে ব্যক্তি রাসুল ও তাঁর সাহাবিদের অনুসরণ করে, সে-ই জামাআহ।
আর আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) আমাদের সত্যের ওপর ঐক্যবদ্ধ হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, তিনি বলেন:
আরও বলেছেন:
তিনি আরও বলেন:
তো, আল্লাহ আমাদেরকে বিভক্তি থেকে নিষেধ করেছেন এবং আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসুলের সুন্নাহর ওপর ঐক্যবদ্ধ থাকার আদেশ দিয়েছেন:
অতএব, নিজের খেয়ালখুশির অনুসরণ করে মতভেদ করা ও দলবিভক্ত হওয়া বৈধ নয়; তেমনিভাবে নিজের পিতা ও পূর্বপুরুষদের বা ইহুদি ও খ্রিস্টানদের অন্ধভাবে অনুসরণ করাও বৈধ নয়। আকিদাহগত বিষয় এবং দ্বীনের মূল ভিত্তিসমূহে মতভেদ করা জায়েয নেই; বরং এসব বিষয়ে ঐকমত্য ও ঐক্যবদ্ধ হওয়া আবশ্যক... মূল কথা হলো, বিশ্বাসসংক্রান্ত (আকিদাহ) বিষয়ে মতভেদের কোনো অবকাশ নেই। কারণ শুধুমাত্র নস (কুরআন-সুন্নাহর প্রমাণ) এর ভিত্তিতেই আকিদাহ প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে ইজতিহাদি ব্যাখ্যা বা ব্যক্তিগত মতামতের কোনো স্থান নেই।” [২১]
তাঁরা আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসুলের সুন্নাহতে যা কিছু প্রতিষ্ঠিত হতো, বিষয়বস্তু যাই হোক না কেন, তাতে কোনো দ্বিধা বা অনিশ্চয়তা প্রকাশ করতেন না। সেখানে বর্ণিত তথ্যাবলি—তা হোক অতীতের ঘটনা বা ভবিষ্যতের—সম্পর্কে তাঁরা কখনো সন্দেহ পোষণ করতেন না। তাঁরা কিতাব বা সুন্নাহতে যা কিছু পাওয়া যেত, তা থেকে নিজেদের অব্যাহতি দেওয়ার চেষ্টা করতেন না; বরং যেকোনো সংশয় দ্বারা আক্রান্ত হয় না এমন বাধ্যতামূলক ও অপরিহার্য ঈমানের সাথে তা বিশ্বাস করতেন।
তো, যখন প্রাথমিক নেককার প্রজন্মসমূহের সমাপ্তি ঘটলো এবং মুসলিম অঞ্চলগুলোতে বাইজেন্টাইন ও পারস্য সংস্কৃতির মতো বৈদেশিক সংস্কৃতি (বিবিধ মতবাদ) অনুপ্রবেশ করলো, তখন কিছুটা বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতার সৃষ্টি হলো। পথভ্রষ্টতার দাঈরা এই বিপথগামী মতাদর্শগুলো ছড়িয়ে দিতে সক্রিয় হয়ে উঠলো। সেই প্রেক্ষাপটে আহলুল ইলমরাও আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের সঠিক আকিদাহ স্পষ্ট করার জন্য সক্রিয় হয়ে উঠলেন—যার ওপর ছিলেন আল্লাহর রাসুল (ﷺ)-এর সাহাবিগণ এবং তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণকারী পরবর্তী দুই প্রজন্ম। তাঁরা সুনির্দিষ্টভাবে আকিদাহ লিপিবদ্ধ করে কিতাবে রেকর্ড করলেন যেগুলো বিভিন্ন শিরোনামে নামকরণ করা হয়েছিল, যেমন: ‘আল-ঈমান’, ‘আশ-শারী‘আহ’, ‘আল-ই‘তিকাদ’, ‘আস-সুন্নাহ’, ‘আত-তাওহীদ’ ইত্যাদি। এসব বইয়ে তারা ভ্রান্ত বিরোধীদের খণ্ডন করতেন। আর এটা ছিল এই উম্মাহর প্রতি আল্লাহর রহমত, যাতে তাদের দ্বীন বিদআত (নতুন উদ্ভাবন) থেকে নিরাপদ এবং জারি থাকে।
তিন: ইয়াজুজ-মাজুজ (গগ ও ম্যাগগ) সম্পর্কে সহিহ বর্ণনার অস্বীকার
ইয়াসির কাদি বলেছে: “মধ্যযুগীয় উলামারা এধরনের বিষয়ে বিশ্বাস করতেন। স্পষ্টতই, আমি বলতে পারি—যে ব্যক্তি বিজ্ঞান, ভূগোল ও আধুনিক সভ্যতা সম্পর্কে জানে, সে চার হাজার বছর ধরে একটি প্রাচীরের পিছনে আটকা পড়ে থাকা গোত্রের অস্তিত্বের কথা বিশ্বাস করতে পারে না। আমি বুঝাচ্ছি, আপনি যদি তা বিশ্বাস করেন, তাহলে সেটা আপনার অবস্থান; আমি এতে বিশ্বাস করতে পারি না। আমি সততার সাথে বলছি, এটা বিশ্বাস করা আমার পক্ষে খুবই কঠিন।”
সুতরাং, ইয়াসির কাদি বুখারি ও মুসলিম কর্তৃক সমর্থিত বর্ণনাগুলোকে প্রত্যাখ্যান ও অস্বীকার করছে—যেগুলো হাদিসের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সহিহ সনদবিশিষ্ট!
যে ব্যক্তি দাবি করবে যে, ইয়াসির কাদি আল্লাহর সিরাতুল মুস্তাকিম, সুন্নাহ ও হাদিস থেকে বিচ্যুত হয়নি, সে হয় জাহিল (অজ্ঞ) নয়তো ইয়াসির কাদির মতোই একজন পথভ্রষ্ট বিপথগামী—আর আমাদের নবির (ﷺ) সুন্নাহর প্রত্যাখ্যানকারী এবং সাহাবাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর বর্ণনাসমূহের অস্বীকারকারী।
অতএব আমরা ইয়াসির কাদিকে জিজ্ঞেস করি: “তাহলে, রাসুলুল্লাহ (ﷺ) কি এসব হাদিস বর্ণনায় মিথ্যা বলছিলেন? তিনি কি ওয়াহির মাধ্যমে কথা বলতেন না? নাকি সাহাবারা তাঁর থেকে যা বর্ণনা করেছেন তা মিথ্যা ছিল? অথবা হাদিসের ইমামগণ—বুখারি, মুসলিম, আবু দাউদ, ইবনু মাজাহ প্রমুখ—সনদ পরম্পরা (আসনিদ) দিয়ে এই নসগুলোর বিশুদ্ধতা যাচাইয়ে মিথ্যাবাদী বা অযোগ্য ছিলেন? এর কোনটি?”
ইমাম আল-বুখারি (৭০৫৯ নং) যাইনাব বিনতে জাহশ থেকে বর্ণনা করেন: “নবি (ﷺ) লালচে চেহারা নিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠে বললেন, ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই। আরবদের জন্য ধ্বংস, যে মহা বিপদ তাদের দিকে আসন্ন তার কারণে! আজ ইয়াজুজ-মাজুজের প্রাচীরে এভাবে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে—(তাঁর আঙ্গুল দিয়ে বৃত্তাকার ইশারা করলেন)।” কেউ জিজ্ঞেস করলো, “আমাদের মধ্যে নেককার লোক থাকা সত্ত্বেও কি আমরা ধ্বংস হয়ে যাবো?” তিনি বললেন, “হ্যাঁ, যখন পাপাচার বেড়ে যাবে।”
আবু সাঈদ আল-খুদরি (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
“ইয়াজুজ-মাজুজ গোত্রগুলো মুক্ত হয়ে বের হবে, আল্লাহর বাণী:
তারা সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে। মুসলিমরা তাদের থেকে পালিয়ে নিজেদের শহর ও দুর্গে আশ্রয় নেবে, তাদের পশুপালসহ। ইয়াজুজ-মাজুজ একটি নদীর পাশ দিয়ে যাবে এবং সম্পূর্ণ পানি পান করে ফেলবে। শেষ দলটি এসে বলবে, ‘এখানে একসময় পানি ছিল।’ তারা পৃথিবীতে প্রাধান্য বিস্তার করলে তাদের নেতা বলবে, ‘এরা ছিল পৃথিবীবাসী, আমরা তাদের নির্মূল করেছি। এখন আসমানবাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করি!’ তখন একজন তার বর্শা আকাশের দিকে নিক্ষেপ করবে, তা রক্তমাখানো অবস্থায় ফিরে আসবে। তারা বলবে, ‘আমরা আসমানবাসীদেরও হত্যা করেছি।’ এমন অবস্থায় আল্লাহ তাদের গলায় ভেড়ার নাকের জীবাণুর মতো কীট প্রেরণ করবেন। তারা পঙ্গপালের মতো একের ওপর এক মারা যাবে। সকালে মুসলিমরা তাদের কোনো আওয়াজ পাবে না। তারা বলবে, ‘কে আল্লাহর ওয়াস্তে নিজের আত্মাকে বিক্রি করে তাদের কী অবস্থা দেখবে?’ একজন মারা যাবে জেনে প্রস্তুতিপূর্বক নেমে এসে তাদের সবাইকে মৃত দেখে বলবে, ‘সুসংবাদ! তোমাদের শত্রুরা মারা গেছে!’ লোকেরা বের হয়ে পশুচারণের জন্য ছেড়ে দেবে, কিন্তু ঘাসের পরিবর্তে তাদের (ইয়াজুজ-মাজুজের) গোশত ছাড়া আর কিছুই পাবে না। এতে পশুরা এমন মোটাতাজা হবে যেন সর্বোৎকৃষ্ট ঘাসে চরে বেড়িয়েছে।” [২৫]
অন্য বর্ণনায় রাসুল মুহাম্মাদ (ﷺ) বলেন, তিনি মিরাজের রাতে ঈসা (আলাইহিস সালাম) এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। ঈসা (আলাইহিস সালাম) বললেন: “লোকেরা (ইয়াজুজ-মাজুজ থেকে বাঁচতে) আল্লাহর কাছে দুআ করবে। আর আমি তাদের ধ্বংসের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবো। পৃথিবী তাদের দুর্গন্ধে পূর্ণ হবে। লোকেরা দুআ করবে, আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করবো। তখন আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হবে যা তাদেরকে নিয়ে সমুদ্রে নিক্ষেপ করবে। পর্বতগুলো ধূলিকণায় পরিণত হবে এবং পৃথিবী চামড়ার মতো সমতল হয়ে যাবে। আমাকে ওয়াদা দেওয়া হয়েছে, যখন এমন হবে, তখন কিয়ামাত গর্ভবতী নারীর মতো আকস্মিকভাবে এসে পড়বে—যেমন তার পরিবার জানে না সে কখন প্রসব করবে।” [২৬]
চার: ইয়াসির কাদির নবি (ﷺ)-এর জন্মদিন (ঈদে মিলাদুন্নবি) উদযাপনের বৈধতাদান
ইয়াসির কাদি বলেছে: “মাওলিদের (মিলাদুন্নবি) ব্যাপারে, উদাহরণস্বরূপ, আল-হাফিয ইবনু হাজার অত্যন্ত স্পষ্ট ছিলেন। ইবনু হাজারের একটি সুন্দর ফাতওয়া: তিনি বলেন—দেখুন, টেকনিক্যাল অর্থে, অবশ্যই, এটি বিদআত (নবউদ্ভাবন)। ইবনু হাজার, তিনি এটা বলছেন। নবি (ﷺ) তা করেননি, সাহাবিরাও করেননি। কিন্তু যদি সেদিন মানুষ একত্রিত হয়, সাদাকাহ দেয়, নবির (ﷺ) ফাযাইল (মর্যাদা) বর্ণনা করে, যিকর করে, তাহলে তা বিদআতে হাসানাহ (একটি সুন্দর নবউদ্ভাবন)। এতে সমস্যা কী?”
নবিজির (ﷺ) জন্মোৎসবের এই বিদআত সর্বপ্রথম চালু করে বানু উবাইদ আল-কাদ্দাহ গোত্র—যারা নিজেদেরকে ফাতিমিদ বলে দাবি করতো। ইমাম আয-যাহাবি ‘আস-সিয়ার’-এ (১৫/১৪১) উল্লেখ করেছেন যে তারা বাতিনি, রাফিদি ও ইসমাঈলি শিয়া ছিল। সুন্নাহ বা ইসলামের সাথে এর উৎসের কোনো সম্পর্ক নেই। তারা আলি ইবনু আবি তালিব, ফাতিমা, হাসান ও হুসাইন (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-এর জন্মদিনও উদযাপন করতো—এমনকি ক্রিসমাসও। তারা আব্বাসীয় শাসনামলে আবির্ভূত হয় এবং ৩৬০ হিজরি থেকে মিশর শাসন করে। তারা বিশ্বাস করতো যে আল্লাহ সৃষ্টির মাঝে অবস্থান করেন; ওয়াহির গূঢ় রহস্যময় ব্যাখ্যা রয়েছে যা শুধু তাদের উলামা ও ‘পীর-দরবেশ’-দের জানা—যার কারণে সে যুগের আহলুস সুন্নাহর উলামারা তাদেরকে কুফফার বলে বিবেচনা করতেন। তাদের আগে রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্মোৎসব (মাওলিদ) পালনের কোনো অস্তিত্ব ছিল না।
অতএব, সুপথপ্রাপ্ত ব্যক্তি সে-ই যে নিজেকে রাসুল (ﷺ)-এর শিক্ষার কাছে সমর্পণ ও সোপর্দ করে। শরিয়াহ ও দ্বীনে আল্লাহ যে বিধান দেননি, তা কারো জন্য প্রবর্তন করা জায়েয নয়।
আয়িশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
মুসলিম তাঁর সহিহে (১৭১৮) আয়িশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) থেকে আরও বর্ণনা করেন:
পাঁচ: সালাফি আকিদাহ ও দাওয়াহর ওপর আক্রমণ এবং উমার ইবনুল খাত্তাবকে (রাদিয়াল্লাহু আনহু) হেয়প্রতিপন্ন করা
ইয়াসির কাদি বলেছে: “সালাফিবাদের (Salafism) কিছু নেতিবাচক দিকও রয়েছে। ইন মাই হাম্বল অপিনিয়ন, এর সবচেয়ে বড়ো নেতিবাচক দিক হলো—এটি ধর্মতত্ত্ব, ধর্মতত্ত্বের (আকিদাহর) বিমূর্ত (Abstract) বিষয়গুলোকে, প্রকৃত ধার্মিকতারও ওপরে, চূড়ান্ত লক্ষ্য বানিয়েছে। ফলে অনেক সালাফির কাছে আল্লাহর সিফাত (গুণাবলি) সাব্যস্ত করা ঐ গুণাবলির মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদাহ করার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”
“এবং সালাফিদের উপলব্ধি করতে হবে—আর আমি খুব স্পষ্ট করেই বলবো—যদি উমার ইবনুল খাত্তাব (রাদিয়াল্লাহু আনহু) আজ আমাদের মাঝে উপস্থিত থাকতেন এবং তাঁকে আকিদাহর বিষয়ে কোনো কুইজ দেওয়া হতো, বাস্তবতা হলো আপনারা যে পরীক্ষা নিতেন তাতে তিনি ফেল করতেন।”
“সালাফিবাদ (Salafism) এক ধরনের প্রোটেস্ট্যান্ট ইসলাম এবং এজন্যই সালাফিরা প্রতীক (আইকন) পছন্দ করে না...” (অতঃপর কাদি সন্ত্রাসী দলগুলোর দায় সালাফিয়্যাহর ওপর চাপায়)... “বেশিরভাগ ওয়াহাবি বেশ অরাজনৈতিক ও শান্তিকামী। তাদেরকে আপনি আমিশ (খ্রিস্টান) বা আল্ট্রা-অর্থোডক্স ইহুদিদের মতো বিবেচনা করতে পারেন... এটাই ওয়াহাবিবাদের ধর্মতত্ত্ব।”
এছাড়াও, শাইখ আল-ফাওযানকে জিজ্ঞেস করা হয়: ‘নিজেকে সালাফি হিসেবে লেবেল করা কি দলাদলি (তাহাযযুব) বোঝায়?’
শাইখ উত্তরে বলেন: “নিজেকে সালাফিয়্যাহর সাথে সম্পৃক্ত করা—যদি তা সত্য হয়—তাহলে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু যদি তা কেবল দাবি হয়, তাহলে কেউ সালাফদের মানহাজের বিপরীতে থাকা সত্ত্বেও নিজেকে সালাফি বলে দাবি করা নাজাযেয়। উদাহরণস্বরূপ, আশআরিরা বলে ‘আমরা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ’। আর তা সত্য নয়, কারণ তারা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহর মানহাজে নেই। একই কথা মুতাযিলাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য যারা নিজেদেরকে মুওয়াহহিদিন (তাওহিদের অনুসারী) বলে দাবি করে।
কবিতায় যেমন বলা হয়েছে: ‘সবাই লায়লার প্রেমিক হওয়ার দাবি করে, কিন্তু লায়লা নিজে কারো দাবি স্বীকার করে না।’
সুতরাং যে ব্যক্তি দাবি করে সে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহর মাযহাবের ওপর রয়েছে, তাকে অবশ্যই তাদের পথ অনুসরণ করতে হবে এবং বিরোধীদের (মুখালিফিন) পরিত্যাগ করতে হবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি গিরগিটি ও মাছকে একত্র করতে চায়—যেমন প্রবাদে বলা হয়—অর্থাৎ সে স্থলজ ও জলজ প্রাণীকে একত্র করতে চায়, তবে তা অসম্ভব; অথবা সে একই পাত্রে আগুন ও পানিকে একত্র করতে চায়।
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহকে তাদের বিরোধী মাযহাবগুলোর সাথে একত্র করা সম্ভব নয়—যেমন খাওয়ারিজ, মুতাযিলা, হিযবিদের মধ্যে যারা নিজেদেরকে ‘সমসাময়িক মুসলিম’ বলে। তাই সে এই যুগের পথভ্রষ্টদেরকে সালাফদের মানহাজের সাথে একত্র করতে চায়। কিন্তু [আমরা তাকে বলি]: ‘এই উম্মাহর পরবর্তী অংশ ঐ উপায়েই সংশোধিত হবে যে উপায়ে তার পূর্ববর্তী অংশ সংশোধিত হয়েছিল।’ সুতরাং বিষয়গুলোর পৃথকীকরণ ও স্পষ্টীকরণ জরুরি।” [২৯]
ছয়: ক্রিসমাস উদযাপন ও বিদআত সমর্থনে উলামাদের ছোট করা
ইয়াসির কাদি বলেছে: “প্রশ্নকারিণী একটি ওয়েবসাইটে গিয়ে বলেন—ফিনল্যান্ড থেকে ৫,০০০ মাইল দূরে বসবাসরত একজন আলিম ফাতওয়া দিয়েছেন যে, কোনো ধর্মান্তরিত (মুসলিম) ব্যক্তির জন্য ক্রিসমাসের দিনে তার পরিবারের কাছে যাওয়া গুনাহ, কারণ এটি একটি পৌত্তলিক উৎসব। আপনি যে ফাতাওয়া এবং ওয়েবসাইটগুলোর উদ্ধৃতি দিয়েছেন, তাদের প্রাপ্য সম্মান রেখেই বলছি—তারা বুঝতে পারছেন না ক্রিসমাসের পারিবারিক গ্যাদারিং আসলে কী।
তারা খ্রিস্টান সভ্যতার সাথে কখনো মেলামেশা করেননি। তারা আমাদের বাস করা বিশ্ব থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জগতে বাস করেন, তাই তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বক্র (সংকীর্ণ)। আমরা সবাই জানি যে ক্রিসমাসের দিন বা ক্রিসমাস ইভের রাতে পারিবারিক গ্যাদারিং মূলত একটি পারিবারিক অনুষ্ঠান—সাধারণত কোনো ধর্মীয় বিষয়ই থাকে না। এ ধরনের সাধারণ উৎসবে পরিবারের সাথে অংশ নেওয়া আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদাতের অন্তর্ভুক্ত নয়, এতে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো দাসত্বের কোনো ইঙ্গিত নেই। ৫,০০০ মাইল দূরের কেউ বলে, ‘ওহ, তোমার যাওয়া হারাম।’ না, এটা তোমার জন্য হারাম নয়, একেবারেই নয়। তুমি ক্রিসমাস উদযাপন করছো না।”
সুন্নাহর উলামারা বলেন যে, মুসলিমদের অমুসলিমদের উৎসব থেকে দূরে থাকা উচিত এবং তাদের বুঝাতে হবে যে ইসলাম আল্লাহর মনোনীত দ্বীন—যার স্বতন্ত্র ঐতিহ্য ও আত্মপরিচয় রয়েছে; যা কুরআন-সুন্নাহতে স্পষ্ট উল্লেখ নেই এমন অনৈসলামিক আচার ও অনুষ্ঠানে অংশ নিতে নিষেধ করে। যদি কেউ জিজ্ঞেস করে: অমুসলিমদের ধর্মীয় উৎসবে অংশ নেওয়া কোথায় স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ? আমরা বলি: আনাস (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেন, নবি (ﷺ) মদিনায় হিজরত করার পর দেখলেন লোকেরা বছরে দুটি নির্দিষ্ট উৎসব পালন করছে। কিছু উলামার মতে এটি পারসিকদের উৎসব ছিল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “এ দিন দুটো কী?” তারা জানালো যে এগুলো ইসলামপূর্ব যুগের (জাহিলিয়্যাহর যুগ) উৎসব। তখন তিনি বললেন:
অমুসলিম দেশে তাদের উৎসবে অংশগ্রহণ সম্পর্কে বলা হলে: নবিজির সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেছেন, “যে ব্যক্তি অমুসলিম দেশে বসবাস করে এবং তাদের নওরোজ ও মেহেরজান (পারসিক উৎসব) উদযাপন করে, তাদের অনুকরণ করে এবং এ অবস্থায় মারা যায়, কিয়ামাতের দিন তাকে তাদের সাথেই উঠানো হবে।” [৩১]
মরিয়মপুত্র ঈসার তথাকথিত জন্মদিন উদযাপন ইসলামের মৌলিক শিক্ষার সাথে বড়ো ধরনের সাংঘর্ষিক বিশ্বাস বহন করে, যেমন: তাদের দাবি হলো—“ঈসা হলেন আল্লাহর একমাত্র পুত্র যিনি এ দিনে জন্মগ্রহণ করেন।” অথচ আল্লাহ বলেন:
ইবনু নাহহাস বলেন: “জেনে রাখুন, সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিদআতগুলোর একটি হলো—মুসলিমদের খ্রিস্টানদের বার্ষিক উৎসবে অংশগ্রহণ, তাদের খাদ্য ও কার্যকলাপ অনুকরণ, তাদেরকে উৎসবে উপহার দেওয়া এবং তাদের কাছ থেকে উপহারস্বরূপ খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করা। মিশরের অধিবাসীদের মধ্যে এই বিদআত প্রচলিত ও চর্চিত, আর এতে দ্বীনদারির দুর্বলতা বিদ্যমান।” [৩৩]
ইয়াসির কাদি বলেছে: “স্লোগান ও সমাধানের মধ্যে পার্থক্য করুন। আমরা প্রায়ই সুন্দর স্লোগানের ফাঁদে পড়ে যাই—এগুলো অনেক সময় লেজিটিমেট ও সঠিক হলেও বাস্তব সমাধান দিতে ব্যর্থ। যেমন: ‘ইসলামই সমাধান’, ‘আমাদের কুরআন-সুন্নাহর দিকে ফিরে যেতে হবে’, অথবা কিছু গোষ্ঠী বলে ‘আমাদের সালাফ বা নেককার পূর্বসূরীদের আদর্শে ফিরে যেতে হবে’। আবারও বলছি, এটি ভালো স্লোগান এবং এতে হকের অংশ রয়েছে—যেমন সাহাবাদের অনুসরণ করা, সাহাবাদের বা তাঁদের ছাত্রদের সম্মান করা। কিন্তু বলুন তো, সেই প্রাথমিক প্রজন্মগুলো ইসলামোফোবিক মিডিয়ার বিরুদ্ধে কীভাবে সংগঠিত হয়েছিলেন? যখন তাঁদের সংসদ সন্ত্রাসবিরোধী আইন পাস করতে যাচ্ছিল, যা আসলে ধার্মিকতাকে নিষিদ্ধ ও ক্রিমিনালাইজ করবে, তখন তারা কীভাবে তাদের রাজনীতিবিদ ও সংসদকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন? আপনি এমন কিছু পাবেন না, কারণ তাদের সময় এমনটা ঘটেনি। সুতরাং আপনি যখন আমাকে অতীতে ফিরে যেতে বলেন—ঠিক আছে, আমি মানছি যে তাঁদের সম্মান করা উচিত। কিন্তু তা আমাকে কোনো সমাধান দেয় না।”
আরও পড়ুন: আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের (ﷺ) অবাধ্যতাই উম্মাহর বিপর্যয় ও পরাজয়ের কারণ: উহুদ যুদ্ধ থেকে শিক্ষা
এই সাতটি পয়েন্টের উদ্ধৃতিগুলো ইয়াসির কাদির ভ্রান্তি তুলে ধরা একটি ভিডিয়ো সংকলন থেকে নেওয়া হয়েছে। [৩৪]
[১] ইয়াসির কাদির সাথে রেকর্ডকৃত ওয়েবিনার
এতো ডিটেইলড ও ইনফরমেটিভ লেখার জন্য জাযাকুমুল্লাহু খাইরান! অনেক উপকৃত হয়েছি। আজ থেকে তাকে বর্জন করলাম।
আল্লাহ আপনাকে কবুল করুন, বারাকাল্লাহু ফিক।