রাস্তায় মিছিল, বিক্ষোভ ও পণ্য বয়কট কি অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর বৈধ উপায়? : প্রথম পর্ব
মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল যেমন ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, সিরিয়া এবং অন্যান্য স্থানে মুসলমানরা নিপীড়িত হচ্ছে। আমরা দেখতে পাই যে, সালাফিরা এই নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার আহ্বানকে কখনও সমর্থন করেন না, এমনকি এই দেশগুলোর পণ্য বয়কটের আহ্বানেরও সমর্থন দেন না। দয়া করে কি ব্যাখ্যা করবেন—সালাফিরা কেন এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ায় না?
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি সকল সৃষ্টির রব। আল্লাহ আমাদের নবি মুহাম্মাদের নামকে ফেরেশতাদের মহান সমাবেশে উচ্চ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করুন, তাঁর ওপর শান্তি ও নিরাপত্তা বর্ষণ করুন—এবং অনুরূপভাবে তাঁর পরিবার-পরিজন, সাহাবাহ এবং কিয়ামাত পর্যন্ত তাঁর যথাযথ অনুসারী সবার ওপর।
এ যুগ ও সময়ের জন্য প্রশ্নটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। এর কারণ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে মুসলমানরা আসলেই নিপীড়িত হচ্ছে। কুফফার এবং রাফিদাহ, খাওয়ারিজ ও ইসলামের অন্যান্য শত্রুদের হাতে মুসলিমরা নির্যাতনের শিকার।
প্রশ্নকারী উল্লেখ করেছেন যে, ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, ভারত ও সিরিয়ার মতো বিভিন্ন অঞ্চলে মুসলিমরা অত্যাচারিত হচ্ছে—এটা সত্য। প্রশ্নের দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে যে, সালাফিরা কখনও প্রতিবাদের ডাককে সমর্থন করে না। আপনি “প্রতিবাদ” বলতে খুব সম্ভবত রাস্তায় মিছিল করা এবং কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শনকে বুঝাচ্ছেন। এ প্রশ্নের উত্তর বিভিন্নভাবে দেওয়া যেতে পারে। ইনশাআল্লাহ, আমি কয়েকটি দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবো।
প্রতিবাদ ও রাস্তায় মিছিল করার বিষয়ে কুরআন ও সুন্নাহয় কোনো দলিল নেই। রাস্তায় বিক্ষোভ প্রদর্শনের সমর্থনে কোনো প্রমাণ বিদ্যমান নেই যা এর বৈধতা দেয়।
তো, রাস্তায় গণবিক্ষোভের সমর্থনকারীরা বলে: “দেখুন, আল্লাহর রাসুল (ﷺ) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে কেউ কোনো মন্দ দেখে, সে যেন তা হাত দ্বারা প্রতিহত করে। যদি সে তা করতে অক্ষম হয়, তবে যেন মুখে এর বিরোধিতা করে…’, তাই আমরা যাবো, রাস্তায় মিছিল করবো এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলবো।” কিন্তু তারা এই হাদিসকে মন্দ অপসারণের প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করতে ভুল করছে। কারণ, নবি (ﷺ) ও তাঁর সাহাবারা তা অর্জনে বিক্ষোভকে কখনো পদ্ধতি হিসেবে গ্রহণ করেননি, যদিও তা করা তাঁদের জন্য সম্ভব ছিল। বাস্তবে তিনি তাঁদেরকে মক্কার রাস্তায় মিছিলের নির্দেশ দিতে পারতেন, কিন্তু কখনও দেননি, যা মুসলিম বা অমুসলিম দেশে সংশোধনের মাধ্যম হিসেবে তা নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়টির ওপর পুনরায় গুরুত্বারোপ করে। যারা বলে অমুসলিম দেশে তা বৈধ, তাদের মনে রাখা উচিত যে নবি (ﷺ) নিজে দারুল কুফরে (মক্কায়) বসবাস করছিলেন, যেখানে মুমিনদের সাথে সাথে তিনিও নির্যাতিত হয়েছিলেন; তবুও তাঁরা কখনও প্রতিবাদ করেননি।
বিভ্রান্ত দলগুলো রাস্তায় মিছিল করাকে ‘ইবাদাহ’ এবং আল্লাহর পথে সংগ্রামের (জিহাদ) একটি ধরন হিসেবে দাবি করে বলে, “আমরা অসৎকাজ থেকে নিষেধ করছি।” সুতরাং, এখন তাদের ওপর দায়িত্ব বর্তায় যে, তারা তাদের নব উদ্ভাবিত এই ‘ইবাদাহ’-এর পক্ষে আমাদের কাছে দলিল উপস্থাপন করুক।
আল্লাহর রাসুলের (ﷺ) হাদিস বা সাহাবাদের (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) কাছ থেকে এমন কোনো দলিল কি আছে যা দেখায় যে তাঁরা কুফফার বা তাঁদের অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে রাস্তায় মিছিল করেছিলেন? কোথায় প্রমাণ? নবি (ﷺ)-এর সময়ে মক্কায় কি মুসলিমরা অত্যাচারিত হয়নি? তাহলে তাঁরা কি নিপীড়নের বিরুদ্ধে রাস্তায় মিছিল করেছিলেন? তারা কি আবু জাহল ও আবু সুফিয়ানের (যারা ছিল সেসময়ের নেতা) পতনের দাবিতে চিৎকার করেছিলেন? তারা কি তাদের পতনের ডাক দিয়ে কাবাঘরের চারপাশে প্ল্যাকার্ড উঁচিয়ে বিক্ষোভ করেছিলেন? নবি (ﷺ) ও সাহাবারা কি কখনও এমনটি করেছিলেন? তাঁরা যদি অসৎকাজের নিষেধ করার পদ্ধতি হিসেবে তা না করে থাকেন, তবে তোমরা কেন করছো?
হাজ্জাজ বিন ইউসুফের শাসনামলে সাহাবাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, যেভাবে হয়েছিলেন তাবিয়িনরাও। সাহাবি, আবদুল্লাহ বিন জুবাইরকে (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) হাজ্জাজ বিন ইউসুফ হত্যা করে মক্কায় ক্রুশবিদ্ধ করেছিল এবং কাবাঘর ধ্বংস করেছিল—এটি খুলাফায়ে রাশিদিন পরবর্তী সময়ের ঘটনা। তবুও সাহাবাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) কখনও রাস্তায় বিক্ষোভ বা প্রতিবাদ করেননি। কেন? কারণ, এসব সংশোধনের শরয়ি পদ্ধতি নয়; বরং এই বিদআতি পদ্ধতিগুলো অধিকতর অশান্তির দিকে পরিচালিত করে। আর যদি তোমরা প্রমাণ চাও, তবে বর্তমান মুসলিম বিশ্বের দিকে তাকাও—কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ তাদেরকে কোন পরিণতির দিকে নিয়ে গেছে দেখো।
তারা তাদের “আরব বসন্ত” শুরু করেছিল, যা তাদের সকলেই উদযাপন করেছিল। আহলুল বিদআতদের মাঝে তাকফিরিরা, মুসলিম দেশগুলোতে গণতন্ত্র (Democracy) ও উদারনৈতিকতার (Liberalism) দিকে আহ্বানকারী দলগুলো, এবং মিশর, তিউনিসিয়া, লিবিয়া, সিরিয়া ও ইয়েমেনের আল-ইখওয়ান আল-মুফলিসিন—তাকাও এখন সেই দেশগুলোর দিকে!
![]() |
যুদ্ধের আগের ও পরের সিরিয়া, ফটো © PetaPixel |
শাইখ আল-আলবানি (রাহিমাহুল্লাহু তাআলা) তাঁর বিক্ষোভ সম্পর্কিত একটি বক্তব্যে তিনি এসব লোকের ব্যাপারে অবাক হন যারা আল্লাহর শরিয়াহ প্রতিষ্ঠায় রাস্তায় প্রতিবাদ করতে চায়, অথচ তারা তা করে কাফিরদের অনুকরণের মাধ্যমে—যেমন কমিউনিস্ট ও পশ্চিমা গণতন্ত্রে বসবাসকারীদের মতো তারাও রাস্তায় বিক্ষোভ করে।
তোমরা কি কাফিরদের নীতি, তাদের ধর্ম ও পদ্ধতির অনুকরণ করে পরিস্থিতির সংশোধন করতে চাও? আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) তোমাদেরকে বিক্ষোভের অনুমতি দিয়েছেন—এর দলিল কোথায়? তোমরা সাধারণ কোনো আয়াত ও হাদিসের ব্যবহার করতে পারো না, কারণ সাহাবাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) সেসবকে তোমাদের মতো করে বুঝেননি। তোমরা তোমাদের ভ্রষ্টতার বৈধতা দিতে নিজেরাই নিজেদের ব্যাখ্যা উদ্ভাবন করেছো।
আমরা যে ৪ জন প্রসিদ্ধ ইমামের কথা বলি (আবু হানিফা, মালিক, শাফিয়ি, আহমাদ ইবনু হাম্বল)—তাদের মধ্যে কে তোমাদেরকে রাস্তায় বিক্ষোভের নির্দেশ দিয়েছেন? কেউই নন। তাহলে এই ধারণা কোথা থেকে এলো? এটা এসেছে কুফফারদের কাছ থেকে: ইউরোপ, চায়না, রাশিয়া, কমিউনিস্ট ও বলশেভিকদের কাছ থেকে; নব্বইয়ের দশকের শুরুতে বেইজিং স্কয়ারে যারা বিক্ষোভ করে প্রাণ দিয়েছিলো; বার্লিন প্রাচীরের পতনের সময়ের বিক্ষোভ, আর ইউরোপ ও অন্যান্য স্থানে যে বিক্ষোভগুলো আমরা দেখি।
তো, জাহিল ও পথভ্রষ্ট মুসলিমরা ওসব দেখে বলে: “আমরা আমাদের দেশেও এমনটি করবো।” এরপর, তারা কুফফারদের কাছ থেকে এই ধারণা ধার করে এনে বললো: “ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা তাদের পদ্ধতি ব্যবহার করবো।” আর এখন তার শেষ পরিণতি কী দেখুন।
![]() |
‘স্বাধীনতা’র আগের ও পরের লিবিয়া, ফটো © Zhang Meifang (X) |
এজন্যই যখন আল-আলিম, শাইখ আল-ফাওযানকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হয়, তিনি বললেন: “বিক্ষোভ করো না।” শাইখ রাবি আল-মাদখালিকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন: “বিক্ষোভ করো না।” শাইখ উবাইদ আল-জাবিরিকে প্রশ্ন করা হলে তিনি জবাবে বললেন: “বিক্ষোভ করো না।” শাইখ আবদুল মুহসিন আল-আব্বাদকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন: “বিক্ষোভ করো না।” তারা মানুষকে ঘরে থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কেন? কারণ এটি সাহাবাদের মানহাজ নয়।
এবং তাদের পূর্বে যখন ইমাম ইবনু বাযকে (রাহিমাহুল্লাহ) নব্বইয়ের দশকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তিনি এসব বিক্ষোভ থেকে নিষেধ করেছিলেন, ঠিক যেমন নিষেধ করেছিলেন শাইখ ইবনু উসাইমিন ও আল-আলবানি (রাহিমাহুমুল্লাহ)। যারা গণবিক্ষোভ, সমাবেশ ও মিছিলে অংশ নেয়, তারা সমাজ সংশোধনের ক্ষেত্রে সুন্নাহর বিরোধিতা করেছে এবং সালাফদের পথকে প্রত্যাখ্যান করেছে। আল্লাহ তাআলা সুরা আন-নুরের ৬৩ নং আয়াতে বলেছেন:
“কাজেই যারা তাঁর (আল্লাহর রাসুলের) আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে তারা সতর্ক হোক যে, বিপর্যয় তাদের ওপর আপতিত হবে অথবা আপতিত হবে তাদের ওপর যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।”
তাই, এটিই সেই পরিণতি যখন আল্লাহর রাসুলের (ﷺ) সুন্নাহর অমান্য ও বিরোধিতা করা হয়— যার ফলাফল হলো ফিতনাহ ও বিপর্যয়।
![]() |
আর্মচেয়ার খারিজি আহমাদ মুসা জিব্রিল |
সিরিয়া ও লিবিয়ার মতো দেশগুলোর বিক্ষোভ পূর্ববর্তী ও বর্তমান দৃশ্যের প্রতি লক্ষ্য করুন। তিউনিসিয়ায় বিক্ষোভ তাদেরকে কোথায় নিয়ে গেছে দেখুন, দেখুন তা কীভাবে তাকফিরি গোষ্ঠী ও সন্ত্রাসীদের জন্য দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে! প্রতিটি স্থানেই সামাজিক এই বিশৃঙ্খলার ফলে মূলত অত্যাচারী, সীমালঙ্ঘনকারী, সুন্নাহ ও সত্যের বিরোধিতাকারীরা ছাড়া আর কেউই লাভবান হয়নি। এটাই হলো তোমাদের বিক্ষোভের চূড়ান্ত ফলাফল!
Alhamdulillah, great analysis. Needs a whole book on that issue with references from salaf & scholars.
BarakAllahu feek.