‘আকিদাহর’ অর্থ ও গুরুত্ব

সালাফি দাওয়াহ বাংলা



‘আকিদাহর’ অর্থ


কিদাহ (عقيدة) শব্দটি ফা‘ইলাহর (فعيلة) গঠনগত রূপ, যা মাফ‘উল (مفعول)-এর (যার ওপর কোনো কিছু সম্পাদিত হয়) অর্থ বহন করে, অর্থাৎ মা‘কুদান আলাইহি (معقودا عليه)। এর মানে হলো: যা শক্তভাবে বাঁধা, গিঁট দেওয়া, দৃঢ়ভাবে স্থির বা আঁকড়ে ধরা হয়। এটি (عقد) মূলধাতু থেকে উৎসারিত, যার অর্থ—বাঁধা, শক্ত করা, যুক্ত করা বা আবদ্ধ করা।

দ্বীনের বিষয়গুলো আখবার (তথ্য/খবর) ও আহকামে (এমনসব বিধি-বিধান যার জন্য আমল আবশ্যক হয়) বিভক্ত, যেমন আল্লাহ, আযযা ওয়া জাল, বলেন:

وَتَمَّتْ كَلِمَتُ رَبِّكَ صِدْقًا وَعَدْلًا
আর সত্যন্যায়ের দিক দিয়ে আপনার রবের বাণী পরিপূর্ণ হয়েছে… [সুরা আল-আনআম, ৬:১১৫]

আল্লাহর কালাম এই দুইভাবে পরিপূর্ণতা পেয়েছে: তথ্যগত বিষয়ে (আখবার) সত্যতা এবং তাঁর আদেশ ও নিষেধে (আহকাম) ন্যায়বিচার।

আর আখবারের (তথ্যগত বিষয়) ক্ষেত্রে, সেগুলোকে স্বীকার করা ও বিশ্বাস স্থাপন করা (সেগুলোর তাসদিক করা) ওয়াজিব। সুতরাং, যেকোনো বিষয় যা বিশ্বাস (ঈমান) ও স্বীকৃতির (তাসদিক) অন্তর্ভুক্ত এবং আমলকে আবশ্যকীয় বানায় এমন প্রায়োগিক বিষয়ে প্রবেশ করে না, তাকে ‘আকিদাহ’ বলা হয়। কারণ হলো, এর উৎস ও সূচনা হচ্ছে অন্তরের জ্ঞানে। একে ‘আকিদাহ’ বলা হয় কারণ তা অন্তরে প্রবেশ করে এবং অন্তরের সাথে দৃঢ় ও মজবুতভাবে বাঁধা থাকে এবং লেগে থাকে—অর্থাৎ এতোটা শক্তিশালী ও মজবুত বন্ধনে আবদ্ধ ও লেগে থাকে যে, বলা যায়, এটি যাতে কখনো বেরিয়ে বা পালিয়ে না যায় সে ব্যাপারে অন্তর সর্বদা সচেষ্ট থাকে।

আরবিতে যখন বলা হয়, “আকাদাল-হাবল” (عَقَدَ الحبلَ), অর্থাৎ: “সে রশিটি শক্ত করে বাঁধলো”, একইভাবে “আকাদাল-বাই” (عَقَدَ البَيْعَ), অর্থাৎ: “সে বিক্রয় বা লেনদেন বা চুক্তি সম্পন্ন করলো”। আর আল্লাহ এই ক্রিয়াপদটি অঙ্গীকার সম্পাদন (وَالَّذِينَ عَقَدَتْ أَيْمَانُكُمْ, আন-নিসা ৪:৩৩) এবং দৃঢ়ভাবে করা শপথ প্রসঙ্গে (وَلَـكِن يُؤَاخِذُكُم بِمَا عَقَّدتُّمُ الأَيْمَانَ, আল-মায়িদাহ ৫:৮৯) উল্লেখ করেছেন। আর যখন কেউ বলে “আকাদতু কাযা ওয়া কাযা” (عقدتُ كذا وكذا), এর অর্থ – “আমার অন্তর এই এই বিষয়ের ওপর দৃঢ়ভাবে স্থির”।

উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে ‘আকিদাহ’-এর অর্থ এভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়:

এমন দৃঢ় বিশ্বাস (ইতিকাদ) যার সাথে ব্যক্তির অন্তর দৃঢ়ভাবে সংযুক্ত থাকে এবং যা কোনো সংশয় বা সন্দেহ আসা ছাড়াই অন্তরে স্থায়ী ও অটল থাকে। এতে অনুমান, সন্দেহ বা দ্বিধার কোনো অবকাশ থাকে না।

আমলগত বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে, সেগুলোও ঈমানের (বিশ্বাস) অন্তর্ভুক্ত, যেমনটা সর্বজনবিদিত যে, পুরো শরিয়াহই ঈমানের অন্তর্গত, তবে, এসব আমাল অঙ্গপ্রত্যঙ্গের দ্বারা সম্পাদিত হয়, এবং এ কারণে সেগুলো ‘আকিদাহ’ পরিভাষার আওতায় পড়ে না। বরং এগুলো ‘ঈমান’-এর আওতাভুক্ত হবে, এর অংশ হিসেবেই গণ্য হবে এবং “সুন্নাহ” ও “শরিয়াহ” পরিভাষাদ্বয়েরও আওতায় পড়বে – এক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, এসব পরিভাষা বিশ্বাসগত বিষয়ের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয় (এরপর দেখুন)।

‘আকিদাহর’ সমার্থক পরিভাষা


কিছু শব্দ আছে যা ব্যবহারের দিক থেকে ‘আকিদাহ’ ও ‘ই‘তিক্বাদ’-এর সমার্থক, যেমন আত-তাওহিদ (التوحيد), আস-সুন্নাহ (السنة), আশ-শারিয়াহ (الشريعة), আর এদের মধ্যে কিছু পরিভাষা নির্দিষ্টভাবে বিশ্বাসগত বিষয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, যেমন ‘আত-তাওহিদ’, এবং বাকিগুলো বিশ্বাস ও অন্যান্য বিষয় উভয় ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, যেমন ‘আস-সুন্নাহ’ ও ‘আশ-শারিয়াহ’। সালাফদের কেউ কেউ আল-ঈমান (الإيمان) শিরোনামেও গ্রন্থ রচনা করেছেন, যেহেতু জ্ঞানভিত্তিক বিষয়গুলো ঈমানের সামষ্টিক গঠনমূলক অংশ—যা বিশ্বাস (জ্ঞানভিত্তিক বিষয়), কথা ও কাজের মাধ্যমে গঠিত হয়—এর অন্তর্ভুক্ত।

আর সালাফদের রচিত কিতাবসমূহে এসব বিষয়ই বিবৃত হয়েছে। তাঁরা কিতাব রচনা করেছেন এবং সেগুলোকে “কিতাবুস সুন্নাহ” শিরোনাম দিয়েছেন, বহু সালাফ এই শিরোনামে কিতাব রচনা করেছেন, আর “আশ-শারিয়াহ” শিরোনামে, যেমন আল-আজুররির কিতাব; এবং “কিতাবুত তাওহীদ”, যেমন ইমাম আল-বুখারির (তাঁর সহিহে) ও ইবনু খুযাইমার কিতাব। আর এসব কিতাবে আকিদাহর বিষয়গুলো আলোচিত হয়েছে, যেমন: আল্লাহর নাম ও গুণাবলি (আসমা ওয়াস সিফাত), আল-ঈমান (বিশ্বাস), আল-কাদর (তাকদির) ইত্যাদি।

প্রথম যুগের সালাফদের কিতাবের তালিকা


নিম্নে উল্লিখিত শব্দসমূহ ব্যবহার করে সালাফদের রচিত কিছু কিতাবের তালিকা দেওয়া হলো:

  • “কিতাবুল ঈমান” - আল-ইমাম ও মুজতাহিদ আবু উবাইদ আল-কাসিম ইবন সাল্লাম (মৃ. ২২৪হি)
  • “কিতাবুল ঈমান” - আল-ইমাম ইবনু আবি শাইবাহ (মৃ. ২৩৫হি)
  • “উসুলুস সুন্নাহ” - আল-ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (মৃ. ২৪১হি)
  • “কিতাবুল ঈমান” (তাঁর সহিহে) - আল-ইমাম আল-বুখারি (মৃ. ২৫৬হি)
  • “কিতাবুত তাওহিদ” (তাঁর সহিহে) - আল-ইমাম আল-বুখারি (মৃ. ২৫৬হি)
  • আস-সুন্নাহ” - ইমাম আহমাদের ছাত্র আবু বকর আল-আসরাম (মৃ. ২৭৩হি)
  • “কিতাবুস সুন্নাহ” (সুনান গ্রন্থের অংশবিশেষ) - আল-ফকিহ ও ইমাম আবু দাউদ আস-সিজিস্তানি (মৃ. ২৭৫হি)
  • “আসলুস সুন্নাহ” - হাফিয ও ইমাম আবু হাতিম আর-রাযি (মৃ. ২৭৭হি)
  • আস-সুন্নাহ” - কাদি ও হাফিয ইবন আবি আসিম (মৃ. ২৮৭হি)
  • আস-সুন্নাহ” - আল-হাফিয আব্দুল্লাহ ইবন ইমাম আহমাদ (মৃ. ২৯০হি)
  • আস-সুন্নাহ” - আল-কাদি ও মুহাদ্দিস আবু বকর আল-মাররুযি (মৃ. ২৯২হি)
  • আস-সুন্নাহ” - ইমাম আহমাদের ছাত্র আল-মারওয়াযি (মৃ. ২৯২হি
  • “সারিহুস সুন্নাহ” - আল-মুজতাহিদ, মুফাসসির ও ইমাম ইবন জারির আত-তাবারি (মৃ. ৩১০হি)
  • “কিতাবুত তাওহিদ” - আল-ফকিহ ও ইমাম ইবন খুযাইমাহ (মৃ. ৩১১হি)
  • আকিদাতুত তাহাওয়িয়্যাহ” - ইমাম আবু জাফার আত-তাহাওয়ি (মৃ. ৩২১হি)
  • “শারহুস সুন্নাহ” - ইমাম আল-বারবাহারি (মৃ. ৩২৯হি)
  • “কিতাবুস সুন্নাহ” - আল-কাদি আবু আহমাদ আল-আসাল (মৃ. ৩৪৯হি)
  • আশ-শারিয়াহ” - আল-ফকিহ ও ইমাম আবু বকর আল-আজুররি (মৃ. ৩৬০হি)
  • “কিতাবুত তাওহিদ” - আল-হাফিয ও ইমাম, ইবন মান্দাহ (মৃ. ৩৯৫হি)
  • “শারহ উসুল ইতিকাদ আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ” - আল-হাফিয ও ফকিহ, ইমাম আল-লালিকাঈ (মৃ. ৪২৮হি)
  • আল-ইতিকাদ” - আবু নুআইম আল-আসবাহানি (মৃ. ৪৩০হি)
  • আকিদাতুস সালাফ আসহাবুল হাদিস” - আল-হাফিয ও ইমাম আবু উসমান আস-সাবুনি (মৃ. ৪৪৯হি)

‘আকিদাহয়’ বিচ্যুতি


এসব কিতাব বিদআতি ফিরকাহ ও উদ্ভূত বিদআতিদের খণ্ডনে রচিত হয়েছিল। তাদের মধ্যে রয়েছে: খাওয়ারিজ, রাফিদাহ, কাদারিয়্যাহ, মুরজিয়াহ এবং পরবর্তীতে বিদআতের প্রধান ব্যক্তিবর্গ, যেমন: আল-জাদ বিন দিরহাম, আল-জাহাম বিন সাফওয়ান, ওয়াসিল বিন আতা, আমর বিন উবাইদ প্রমুখ।

শেষোক্ত এই চারজন ছিল জাহমিয়্যাহমু‘তাযিলাহ নামে পরিচিত ফিরকার উদ্ভাবক। দলগুলো “হুদুসুল আজসাম” নামক একটি যুক্তিনির্ভর, বুদ্ধিবৃত্তিক প্রমাণ উদ্ভাবন করে; এটি এমন একটি পদ্ধতি যা দ্বারা প্রমাণ করা হতো যে মহাবিশ্ব হলো ‘হাদিসাহ’ (সৃষ্ট), কারণ তা এমন বস্তু/সত্তা (আজসাম) দ্বারা গঠিত যাদের মধ্যে রয়েছে গুণাবলি (সিফাত), আনুষঙ্গিক বৈশিষ্ট্য (আরাদ) এবং সংঘটন, ঘটনাবলি (হাওয়াদিস)। এটি প্রমাণ করে যে এই ‘বস্তুগুলো’ (আজসাম) পূর্বে অনস্তিত্বের পর সৃষ্ট হয়েছে, ফলে সেগুলো নিজেরাই ‘সৃষ্ট বস্তু’ (হাওয়াদিস) হিসেবে বিবেচিত। অতএব, মহাবিশ্বের সবকিছুই যেহেতু ঘটনাবলি (হাওয়াদিস), তাই এসব সংঘটনের অবশ্যই একজন স্রষ্টা থাকতে হবে, যিনি আল্লাহ। যেসব নাস্তিকদের সাথে তারা বিতর্ক করতো তাদের কাছে এই প্রমাণ উপস্থাপনের জন্য তারা অ্যারিস্টটলের (মৃ. ৩২২ খ্রিস্টপূর্ব) “আল-মাকুলাতুল আশার” (Ten Categories), যা “আল-জাওহার ওয়াল আরাদ” (Substance and Incidental Attributes) নামেও পরিচিত, এর অন্তর্নিহিত পরিভাষা ও শ্রেণিবিন্যাস ব্যবহার করেছিল। এছাড়াও তারা তাদের পূর্ববর্তী এবং যার উৎপত্তিও গ্রিক দার্শনিকদের হাতে ছিল এমন অন্যান্য ধারণাও অন্তর্ভুক্ত করেছিল, যেমন: ডেমোক্রিটাসের (মৃ. ৩৭০ খ্রিস্টপূর্ব) পরমাণুবাদ (Atomism) এবং প্লটিনাসের (মৃ. ২৭০ খ্রিস্টাব্দ) “বিভাজ্যতা ও বহুত্ব থেকে মুক্ত পরম অদ্বিতীয় সত্তা (Transcendent supreme one that is free of divisibility and multiplicity)”-এর ধারণা। এর ফলে, তাদের উদ্ভাবিত প্রমাণটি অকার্যকর হয়ে যাওয়ার আশংকায় নাস্তিকদের কাছে তাদের রবের বর্ণনা দেওয়ার ক্ষেত্রেও তারা এই একই ভাষা মেনে চলতে বাধ্য হয়। এই বাধ্যবাধকতা পরিণামে তাদেরকে আল্লাহ সম্পর্কে বিশ্বাস, বিশেষত তাঁর নামসমূহ, গুণাবলি ও কর্ম এবং আকিদাহর আরও কিছু বিষয়ের ক্ষেত্রে কিতাব (কুরআন) ও সুন্নাহয় যা কিছু রয়েছে তার অনেক কিছু প্রত্যাখ্যান বা ব্যাখ্যা করে উড়িয়ে দেওয়াতে প্ররোচিত করে। এভাবেই তারা যে প্রমাণ উদ্ভাবন করেছিল তার সাথে সাংঘর্ষিক সেই “সমস্যাজনক” নুসুসের (পাঠ্যসমূহ) মোকাবেলা করার জন্য “তাওয়িল” (আক্ষরিক অর্থ পরিত্যাগ করে বিকৃত ব্যাখ্যা) এবং “তাফওয়িদ” (অর্থ আল্লাহর কাছে সোপর্দ করা) এর জন্ম হয়।
এটাই ছিল সেই ইলমুল কালাম (কালামশাস্ত্র) যা আল্লাহর গুণাবলি প্রত্যাখ্যানের ভিত্তি স্থাপন করেছিল এবং সালাফ ও চার ইমাম—আবু হানিফাহ, মালিক, শাফিয়ি ও আহমাদ—যার নিন্দা করেছেন। এই দলগুলো সম্মিলিতভাবে ‘মুতাকাল্লিমুন’ (কালামশাস্ত্রবিদ) নামে পরিচিত; এরা হলো জাহমিয়্যাহ, মুতাযিলাহ, কুল্লাবিয়্যাহ, আশআরিয়্যাহমাতুরিদিয়্যাহ। এই বিদআতিদের ‘ইলমুল কালাম’-এর ক্ষেত্রে সালাফদের একজন আলিমও তাদের সাথে ছিলেন না।

ইবনু সুরাইজ আশ-শাফিয়ি (মৃ. ৩০৬হি) বলেন, যেমনটি তাঁর কাছ থেকে আবু ইসমাঈল আল-হারাওয়ি “যাম্মুল কালাম” গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন এবং ইবনু তাইমিয়্যাহ তাঁর “বায়ান তালবিস আল-জাহমিয়্যাহ” গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন:


توحيد اهل العلم وجماعة المسلمين أشهد أن لا اله الا الله وان محمدا رسول الله وتوحيد اهل الباطل الخوض في الأعراض والأجسام وانما بعث النبي صلى الله عليه وسلم بانكار ذلك


“আহলুল ইলম ও মুসলিম জামাআহর তাওহিদ হলো—‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো (একক) সত্য ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর রাসুল ’। আর আহলুল বাতিলের তাওহিদ হলো আল-আরাদ (আনুষঙ্গিক বৈশিষ্ট্য) ও আল-আজসাম (বস্তু/সত্তা) সম্পর্কে বিতর্কে লিপ্ত হওয়া। অথচ নবি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এসবের প্রত্যাখ্যানের জন্যই প্রেরিত হয়েছিলেন।”

ইমাম আশ-শাফিয়ি (মৃ. ২০৪হি) বলেন, যেমনটি আস-সুয়ুতি তাঁর সাওনুল মানতিক (১/৪৭-৪৮) গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন:

ماجهل الناس ولااختلفوا إلا لتركهم لسان العرب وميلهم إلى لسان ارسطوطاليس

“একমাত্র আরবদের ভাষা পরিত্যাগ করা এবং অ্যারিস্টটলের ভাষার প্রতি তাদের ঝুঁকে পড়ার কারণেই লোকেরা অজ্ঞ হয়ে যায় এবং (একে অপরের সাথে) মতবিরোধে লিপ্ত হয়।”

আশ-শাফিয়ির (রাহিমাহুল্লাহ) এই কথা বিশ্বাস (আকিদাহ) ও ইসলামি আইনশাস্ত্র (ফিকহ) উভয় ক্ষেত্রেই সত্য। কারণ অ্যারিস্টটলীয় অধিবিদ্যা (Metaphysics) ও ত্রুটিপূর্ণ অনুমান (Flawed Syllogism) এবং যুক্তিবিদ্যার অন্যান্য পদ্ধতি এই উভয় শাস্ত্রকেই তাদের জন্য কলুষিত করেছিল যারা অ্যারিস্টটলের ভাষা, যুক্তিবিদ্যা ও অধিবিদ্যার দিকে ঝুঁকেছে।
তাই সালাফগণ এই ফিরকাগুলোর বিরুদ্ধে খণ্ডনমূলক রচনাবলি লিখেছেন, উল্লেখ্য, আশআরিরা ইবনু কুল্লাবের (মৃ. ২৪০হি) আকিদাহর ওপর ছিল এবং তারা পঞ্চম হিজরি শতাব্দীর (৪০০ হিজরির পর) আগে স্বতন্ত্র কোনো ফিরকাহ হিসেবে স্বীকৃত ছিল না। এসব দলগুলো মৌলিক বিষয়ে আহলুস সুন্নাহর বিরোধিতা করেছে, তন্মধ্যে কয়েকটি (উদাহরণস্বরূপ):

  • নাকল/ওয়াহির নুসুস (পাঠ্য)-এর ওপর আকলকে চূড়ান্ত ও নির্ধারক হিসেবে ধার্য করা
  • আকিদাহগত বিষয়ে আহাদ হাদিস প্রত্যাখ্যান করা
  • এই দাবি করা যে, বান্দার ওপর প্রথম ওয়াজিব হলো পর্যবেক্ষণ, (মহাবিশ্ব) পরিদর্শন এবং আল্লাহর অস্তিত্বের সপক্ষে একটি প্রমাণ অনুমান করা
  • এই দাবি যে, ওয়াহির নুসুসগুলোর আপাত অর্থ তাজসিম (দৈহিকরূপ আরোপ) ও তাশবিহ (সাদৃশ্য প্রদান)-এর ধারণা দেয় এবং সেগুলোকে অবশ্যই রূপক ও প্রতীকী ব্যাখ্যার দিকে ঘুরিয়ে দিতে হবে
  • “তানযিহ” (আল্লাহকে পবিত্র ঘোষণা করা)-র চমৎকার দাবির মাধ্যমে বিভিন্ন মাত্রায় আল্লাহর গুণাবলি ও কর্মসমূহ প্রত্যাখ্যান করা; অথচ বাস্তবে তা ছিল তাদের উদ্ভাবিত “হুদুসুল আজসাম” নামক বুদ্ধিবৃত্তিক প্রমাণটির অকার্যকর হওয়া এড়ানোর জন্য—যা তারা নাস্তিক দার্শনিকদের নিজস্ব ভাষা, পরিভাষা ও শ্রেণিবিন্যাস ব্যবহার করেই বের করেছিল। এভাবে তাওহিদ ও আকিদাহ পরিণত হলো আল্লাহ থেকে “বস্তু/সত্তা” (আজসাম), তাদের “আনুষঙ্গিক বৈশিষ্ট্য” (আরাদ) এবং “সংঘটন” (হাওয়াদিস)-এর অস্বীকৃতির ভাষায়। এতে করে তারা পরিত্যাগ করলো সেই ভাষা যা নিয়ে ওয়াহির কিতাবসমূহ ও রাসুলগণ প্রেরিত হয়েছিলেন, এবং সেই নাস্তিক দার্শনিকদের ভাষাই গ্রহণ করলো—যাদেরকে তারা খণ্ডন ও বিরোধিতা করার দাবি করছিল!
এই বিরোধিতাগুলো তাদের কাছ থেকে আসছিল সেই ‘হুদুসুল আজসাম’ নামক বুদ্ধিবৃত্তিক প্রমাণের কারণে, যেটাকে তারা ভুলবশত চূড়ান্ত সত্য হিসেবে বিবেচনা করেছিল—যার ওপর ইসলামের সত্যতা নির্ভর করে বলে তারা মনে করতো। এ বিষয়ে আরও জানতে Asharis.com-এ ভিজিট করুন, যেখানে মুতাযিলাহ ও আশআরিয়্যাহর উৎসগ্রন্থ থেকে এই বিষয়টি বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে।

এখানে মূলকথা হলো: এসব লোকেরা আকিদাহ ও তাওহিদের বিষয়ে বিদআত সৃষ্টি করেছিল, মুসলিমদের সারিকে বিভক্ত করেছিল এবং তাদের বিদআতগুলো ছড়িয়ে দিতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছিল, যতক্ষণ না সুন্নাহ বিদআতে পরিণত হলো এবং সত্য মিথ্যায় রূপান্তরিত হলো। এভাবেই তারা মুসলমানদের ঐক্য ছিন্নভিন্ন করলো, তাদের অন্তরগুলোকে (এসব আকিদাহর মাধ্যমে) বিচ্ছিন্ন করলো, এবং অবশেষে দৈহিকভাবে তাদের বিচ্ছিন্নতা ডেকে আনলো। এভাবেই রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সেই বাণী যে, উম্মাহ ৭৩টি দলে বিভক্ত হবে, তা বাস্তবায়িত হলো।

আকিদাহর গুরুত্ব


পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয় যে, অন্তরে সংরক্ষিত জ্ঞানই হলো একজন ব্যক্তির প্রতিপালক সম্পর্কে বিশ্বাস ও ইবাদাতের ভিত্তি এবং তা তাওহিদের সাথে সম্পৃক্ত। তাই একজন মুসলিমের জন্য সঠিক আকিদাহ, এর অনুসারীএর উৎসসমূহ জানা অত্যন্ত জরুরি। আর তাকে অবশ্যই এমন ব্যক্তির কাছ থেকেই জ্ঞান অর্জন করতে হবে এবং দ্বীনের বিধি-বিধান চাইতে হবে যার আকিদাহ বিশুদ্ধ ও সঠিক। কারণ ভুল আকিদাহর অধিকারী ব্যক্তির কাছে যাওয়া—এমনকি ফিকহি বিধি-বিধান ও দ্বীনি ফাতাওয়া ইত্যাদি আমলগত বিষয়েও—ক্ষতিকর হতে পারে। কেননা, এমন ব্যক্তির ভিত্তি ও বুনিয়াদ এমন কিছুর ওপর প্রতিষ্ঠিত যাতে ভুল বিদ্যমান, আর তা তাদের বাকি ইলম ও আমলের ওপর প্রভাব ফেলবেই, কারণ ফার‘ (শাখা) ‘আসল’ (মূল)-এর অনুসরণ করে।

আর আকিদাহর উৎস হলো আল্লাহর কিতাব, নববি সুন্নাহ যার ব্যাখ্যা, এবং যা সালাফদের—ইসলামের প্রথম তিন শতাব্দীর (৩০০ হিজরি পর্যন্ত) মনীষী এবং পরবর্তীতে যারা নিজেদের বিশ্বাস প্রকাশ ও ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে তাঁদের আকিদাহ, মানহাজ (কর্মপন্থা) ও বক্তব্যের অনুসরণ করেছেন—বুঝ, বক্তব্য, অবস্থান ও ব্যাখ্যা দ্বারা সুদৃঢ় হয়েছে।

আরও পাঠ্য ও রেফারেন্স:

  • শারহু আকিদাতিত তাহাওয়িয়্যাহ - শাইখ সালিহ আল আশ-শাইখ
  • শারহু উসুলিল ই‘তিকাদ - আল-লালিকাঈ
  • বায়ান তালবিসিল জাহমিয়্যাহ - ইবনু তাইমিয়্যাহ
  • যাম্মুল কালাম - আবু ইসমাঈল আল-হারাওয়ি


সোর্স: aqidah.com
পরবর্তী পোস্ট পূর্ববর্তী পোস্ট
কোনো কমেন্ট নেই
কমেন্ট করুন
comment url